(গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছে সোমেন, সাবু ও আরজু। সবাই গান গাইতে গাইতে স্কুলে যাচ্ছে। বেশ তাড়া তাদের। একসময় হঠাৎ থেমে যায় আরজু। ওরা আরজুকে ফেলেই চলে যায়। আরজুর ব্যথা পায়ে। সাবু ফিরে আসে।)
সাবু - কী হলো আবার?
আরজু - আমি যে আর হাঁটতে পারছি না।
সাবু - রোজ রোজ তোর জন্য আমি স্যারের বকুনি খেতে পারব না।
আরজু - ঠিক আছে তোরা যা, আমি একাই এক্ষুনি যাব।
সাবু - থাক তাহলে।
(চলে যায় সাবু। আরজু বসে পড়ে। এ সময়ই ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল এক আইসক্রিমওয়ালা।)
আইসক্রিমওয়ালা - আইসক্রিম, আইসক্রিম চাই আইসক্রিম। কী হলো আরজু মিয়া, তুমি এখানে বসে কী করছ?
আরজু - কিছু না।
আইসক্রিমওয়ালা - স্কুলে যাবে না?
আরজু - না।
আইসক্রিমওয়ালা - স্কুলে ফাঁকি দেওয়া কিন্তু খুব খারাপ, আমিও খুব স্কুল ফাঁকি দিতাম। আমার অবস্থা দ্যাখো। যদি লেখাপড়াটা করতাম তাহলে কি আর আইসক্রিম ফেরি করতে হতো? যাও স্কুলে যাও। চাই আইসক্রিম, আইসক্রিম।
আরজু - ভাই শোনো- তুমি কোন দিকে যাচ্ছ?
আইসক্রিমওয়ালা - আমি তো যাব ঐ বাজারের দিকে।
আরজু - আজ স্কুলের দিকে যাবে না? আইসক্রিম খাব, টিফিন পিরিয়ডের সময়।
আইসক্রিমওয়ালা - ক্লাস যখন চলে তখন তো আর আইসক্রিম বিক্রি হয় না। আমার বাজারের সময় চলে যায়। চাই আইসক্রিম। (আইসক্রিমওয়ালা চলে যায়। হাওয়াই মিঠাইওয়ালার প্রবেশ।)
আরজু - ভাই শোনো।
হাওয়াই মিঠাইওয়ালা - শুধু শুধু ডাকছ কেন? এভাবে সময় নষ্ট হলে আমার হাওয়াই মিঠাই যে শূন্যে মিলিয়ে যাবে।
আরজু - তোমার হাওয়াই মিঠাই কি মেঘের মতো যে, মেঘ জমছে আর শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে।
হাওয়াই মিঠাওয়ালা -হ্যাঁ, মেঘের চাইতেও অনেক হালকা তাই তো মিলিয়ে যায়। যাই চাই হাওয়াই মিঠাই (চলে যায়)।
আরজু -এখন আমি কী করব? বাড়ি গেলে বাবা বলবে স্কুলে ফাঁকি দেওয়ার মতলব-স্কুলে গেলে স্যার বলবে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি তো দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না। এখন কী হবে?
(টিফিনের ঘণ্টা বাজে। সোমেন, সাবু ও আরও ছেলেমেয়ে টিফিন পিরিয়ডে বেরিয়ে আসছে। তারা খেলছে। এ সময়ে আসেন লতিফ স্যার।)
লতিফ স্যার -এই সাবু, এদিকে শোনো- আচ্ছা আরজুকে দেখছি না যে?
সাবু - স্যার মাঝপথে এসে আরজু বলল তোরা যা। এরকম মাঝে মাঝেই করে আরজু।
লতিফ স্যার - কিন্তু কেন করে?
সাবু - এমনিই।
লতিফ স্যার - এমনিই মানে? ইচ্ছে করে? না কি কোনো সমস্যা আছে ওর?
সাবু - জানি না স্যার।
লতিফ স্যার - আচ্ছা। এই যে সোমেন, এদিকে শোনো, তোমার কী মনে হয় আরজু কি ইচ্ছে করেই স্কুল কামাই করছে?
সোমেন - স্যার, ওর যে কী হয়? হঠাৎ করে বলে আমি আর যেতে পারছি না, তোরা দাঁড়া। তখন ওয়ার্নিংবেল বেজে গেছে। আর কি দাঁড়াতে পারি? তাই তো চলে আসি, সেটাই ভালো না স্যার?
লতিফ স্যার - কোথায় যেন একটা সমস্যা মনে হচ্ছে।
মিঠু - স্যার ঐ ছেলেটার সাথে আমারও দেখা হয়েছে।
লতিফ স্যার - কোথায়?
মিঠু - ঐ যে পলাশতলীর আমবাগানের ওখানে বসে আছে। আমার সাথে নানান কথা।
লতিফ স্যার - নানা কথা? তাহলে স্কুলে এলো না কেন?
মিঠু - একসময় বলল তুমি কি স্কুলের দিকে যাবে? আমি বললাম না এখন বাজারে যাব। তারপর টিফিন পিরিয়ডের দিকে স্কুলের দিকে যাব।
লতিফ স্যার - তাহলে তো খুবই চিন্তার কথা। আচ্ছা ঐ আমবাগানে কি এখনও আছে?
সোমেন - মনে হয় এতক্ষণে বাড়ি চলে গেছে।
লতিফ স্যার - তোমরা চলো তো
সাবু - স্যার (ওদের চোখে মুখে অনিচ্ছা। হাওয়াই মিঠাইওয়ালা হেঁকে চলছে-হাওয়াই মিঠাই। লতিফ স্যার ওদের দুইজনকে নিয়েই রওয়ানা দেন।)
(আমবাগান। অসহায় আরজু বসে আছে। একা সে উঠে দাঁড়ায়। একটা পাখি ডাকছে। তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করছে সে।)
আরজু - পাখি, একটু নিচে নাম না। তোমার সাথে কথা কই। আমাকে স্কুলে নিয়ে যাবে? সাবু, সোমেন ওরা কেউ নিয়ে গেল না। তুমি নিয়ে যাও না! তোমার ডানায় ভর করে চলে যাব। কী হলো? নেমে গেলে কেন? মেঘ আমায় নিয়ে যাও না। তোমার কোলে বসে চলে যাব স্কুলে। কী বলছ? ভিজে যাব? ভিজলাম। আবার শুকিয়ে যাব- তবুও তো স্যার বুঝবেন, ছোটো পাখি চন্দনা, এই যে শালিক আমাকে দেখতে পাচ্ছ না? আমি একলা বসে আছি। আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমার সাথে কথা বল না চন্দনা আমায় নিল না, মেঘ আমায় নিল না- শালিক আমার সাথে কথা বলে না।
(আরজু কাঁদতে থাকে। হঠাৎ উপস্থিত হয় লতিফ স্যার।)
লতিফ স্যার - আরজু, তুমি কাঁদছ কেন? তোমার কী হয়েছে? তুমি স্কুলে যাও নি কেন?
সোমেন - কাঁদিস কেন? স্যারকে বল না। (আরজু কাঁদছেই)
লতিফ স্যার - কোনো ভয় নেই, বল।
আরজু - স্যার, আমি বেশি দূর হাঁটতে পারি না। পা দুটো অবশ হয়ে আসে।
লতিফ স্যার - তোমার বাবা-মাকে বল নি কেন?
আরজু - বলেছি- বাবা বলেন হাঁটাহাঁটি করলেই ঠিক হয়ে যাবে।
লতিফ স্যার - তোমার পা দুটো দেখি- এ তো রোগ, তোমার পা চিকন হয়ে গেছে।
আরজু - মা জানে, সেই ছোটোবেলায় কী যেন অসুখ হয়েছিল সেই থেকেই পাটা চিকন- মা বোঝে কিন্তু কাঁদে শুধু।
লতিফ স্যার - তোমরা খেয়াল কর নি?
সোমেন - না স্যার।
লতিফ স্যার - তোমাদের বন্ধু না?
সোমেন - জ্বী স্যার।
লতিফ স্যার - তোমার যদি এরকম হতো?
সোমেন - আমরা বুঝতে পারি নি স্যার। এরকম বুঝলে আমরা দুজনে ধরে এইভাবে নিয়ে যেতাম। (দুজনেই কাঁধে হাত দিয়ে ওকে তুলে ফেলে।)
লতিফ স্যার - বলো স্কুলে যাবে? না কি বাড়ি যাবে?
আরজু - স্কুলে স্যার। (ওদের কাঁধে হাত তুলে আরজু স্কুলে যায়।)
লতিফ স্যার - চলো। দেখি তোমার চিকিৎসার জন্য আমরা কী করতে পারি।
সেই ছেলেটি - 'সেই ছেলেটি' নামক এই লেখাটি একটি নাটিকা। এটি এ বইয়ের আর সব লেখার মতো নয়। এতে কয়েকজন বিশেষ বিশেষ জায়গায় থেকে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। এ ধরনের রচনা কেবল পড়ার জন্য নয়। এগুলো মঞ্চে অভিনয় করে লোককে দেখানো হয়। এ ধরনের লেখা আকারে বড়ো হলে তাকে বলে নাটক।
দৃশ্য - নাটক বা নাটিকায় বিষয়গুলোকে ঘটনাস্থল অনুসারে ভাগ করে নেওয়া হয়। এক-একটি ঘটনাস্থলকে 'দৃশ্য' বলা হয়। 'সেই ছেলেটি' নাটিকার তিনটি ঘটনাস্থলকে তিনটি দৃশ্যে ভাগ করে দেখানো হয়েছে। ১ম দৃশ্য - গ্রামের পাশের রাস্তা। ২য় দৃশ্য - সাবু, আরজুদের স্কুল। ৩য় দৃশ্য আমবাগান।
মতলব - উদ্দেশ্য বা ফন্দি।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (শারীরিক ও মানসিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত) শিশুদের প্রতি মমত্ববোধ সৃষ্টি।
নাট্যকার মামুনুর রশীদ রচিত 'সেই ছেলেটি' একটি নাটিকা। নাটিকাটিতে একটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (শারীরিক ও মানসিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত) শিশুর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। একই সাথে প্রকাশ পেয়েছে শিশুর প্রতি বড়োদের মমত্ববোধ। আরজু, সোমেন ও সাবু তিন বন্ধু একই স্কুলে একই শ্রেণিতে পড়ে। কিন্তু বিদ্যালয়ে হেঁটে আসতে আরজুর খুব কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে তার পা অবশ হয়ে আসে। বন্ধুদের সাথে সমান তালে চলতে পারে না। কখনো কখনো বসে পড়ে। বন্ধুরা আরজুর জন্যে আস্তে আস্তে হাঁটে। তাতে স্কুলে যেতে দেরি হয়ে যায় এবং ওরা শিক্ষকের কাছে বকুনি খায়। আসলে হয়েছিল কি, আরজু ছোটোবেলায় ভীষণ অসুখে পড়েছিল। তাতে তার পা সরু হয়ে যায়। কিন্তু আরজু জানে না কেন তার পা অবশ হয়ে আসে। তার মা জানেন আরজুর অসুখের কথা। তিনি কাঁদেন।
একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে পা অবশ হয়ে গেলে আরজু বন্ধুদের স্কুলে চলে যেতে বলে। সে রাস্তার পাশে বসে থাকে। আইসক্রিমওয়ালা আসে, হাওয়াই মিঠাইওয়ালা আসে। সে তাদের সাথে কথা বলে। তারা চলে যায়। আরজু ভাবে পাখি কিংবা মেঘ তাকে যদি উড়িয়ে নিয়ে স্কুলে দিয়ে যেত!
এদিকে শিক্ষক লতিফ স্যার আরজুকে ক্লাসে না দেখে সোমেনদের কাছ থেকে ঘটনাটি জেনে সোমেনদের সঙ্গে নিয়ে আরজুর খোঁজে রওয়ানা হন। আরজুকে দেখে তিনি বুঝতে পারেন যে আরজুর পা অবশ হয়ে আসা একটা রোগ। তখন লতিফ স্যারের কথায় সোমেনদের মনে সহানুভূতি জাগে। তাদের সহায়তায় আরজু স্কুলে যায়।
মামুনুর রশীদ বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্যকার, অভিনেতা ও নির্দেশক। তিনি ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য নাটক হলো 'ওরা কদম আলী', 'ওরা আছে বলেই', 'ইবলিশ', 'গিনিপিগ' ইত্যাদি।
১. বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের প্রতি মমত্ববোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য পোস্টার, প্ল্যাকার্ড, ব্যানার তৈরি করে র্যালির আয়োজন কর (শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীর কাজ)।
২. নাটিকাটি অভিনয় করে প্রদর্শনের ব্যবস্থা কর (শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীর কাজ)।
১. সেই ছেলেটি নাটিকায় দৃশ্য সংখ্যা কয়টি?
ক. দুইটি
খ. তিনটি
গ. চারটি
ঘ. পাঁচটি
২. আরজু তার বন্ধুদের সাথে স্কুলে যেতে যেতে বসে পড়ে কেন?
ক. সে স্কুলে যেতে চায় না
খ. স্যার তাকে বকুনি দিতে পারে
গ. তার স্কুল ফাঁকি দেওয়ার ইচ্ছা ছিল
ঘ. রোগের কারণে সে হাঁটতে পারে না
৩. 'মা বোঝে কিন্তু কাঁদে' কারণ-
ক. ছেলের পা চিকন হয়ে যাচ্ছে
খ. ছেলের পা একদিন পঙ্গু হয়ে যেতে পারে
গ. ছেলের পায়ের কোনো চিকিৎসা হচ্ছে না
ঘ. ছেলের এই অবস্থায় তিনি অসহায়
উদ্দীপকটি পড়ে ৪ ও ৫ নং প্রশ্নের উত্তর দাও:
রেবেকা কাছের জিনিস দেখতে পায় কিন্তু দূরের জিনিস ঝাপসা দেখে। একদিন সে লক্ষ করল দূরের ঝাপসা জিনিস অর্ধেক দেখা যাচ্ছে আর অর্ধেক পুরো অন্ধকার। মাকে জানালে তিনি বললেন চোখে পানি দিলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।
৪. রেবেকা কোন ধরনের শিশু?
ক. স্বাভাবিক
খ. পুষ্টিহীন
গ. সুবিধাবঞ্চিত
ঘ. বুদ্ধিহীন
৫. 'সেই ছেলেটি' নাটিকা অনুযায়ী রেবেকার প্রয়োজন-
i. মাতা পিতার সহানুভূতি
ii. সমাজের সহানুভূতি
iii. স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ধারণা
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i
খ. i ও ii
গ. i ও iii
ঘ. ii ও iii
১. আবিদ স্যার ৭ম শ্রেণির ছাত্র রওশনের কাছে তার স্কুলে অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইলে সে কিছু না বলে চুপ থাকে। শ্রেণির অন্য শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করলে তারা প্রায় একযোগে বলে স্যার, রওশন প্রায়ই স্কুল কামাই করে। শিক্ষক রওশনকে বলেন-আর কামাই করবে? কোনো উত্তর দেয় না রওশন। পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মেঝে খুঁড়তে থাকে। উত্তর না পেয়ে শিক্ষক রওশনকে অনেক বকা দেন। কয়েকদিন পর রওশনের বাবা আবিদ স্যারকে বলেন-স্যার, রওশনের স্নায়ু রোগ আছে। নিয়মিত স্কুল করলে ওর অসুখটা বেড়ে যায়। বকাঝকা করলে ওর স্কুলে আসা বন্ধ হয়ে যাবে।
ক. মিঠু আরজুকে কোথায় বসে থাকতে দেখেছে?
খ. আইসক্রিমওয়ালা আরজুকে স্কুল ফাঁকি দিতে নিষেধ করল কেন?- বুঝিয়ে লেখ।
গ. রওশন ও আরজুর মধ্যকার সাদৃশ্য ব্যাখ্যা কর।
ঘ. আবিদ স্যারের বিচার কাজটি লতিফ স্যারের তুলনায় কতটুকু যৌক্তিক হয়েছে? তা মূল্যায়ন কর।
common.read_more