লখার একুশে (দ্বিতীয় অধ্যায়) (আবুবকর সিদ্দিক)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - সপ্তবর্ণা গদ্য | - | NCTB BOOK
539
539

লখার রাতের বিছানা ফুটপাতের কঠিন শান। এই শান দিনের বেলায় রোদে পুড়ে গরম হয়। রাতে হিম লেগে বরফের মতো ঠান্ডা হয়। ঠান্ডা শানে শুয়ে লখার বুকে কাশি বসে। গায়ে জ্বর ওঠে।

বাপকে লখা দেখেনি। চেনে না। মা তার ত্যানাখানি পরে দিনভর কেঁদে-কেঁদে ভিখ মেঙে ফেরে। লখার দিন কাটে গুলি খেলে, ছেঁড়া কাগজ কুড়িয়ে, বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি করে আর খাবারের দোকানের এঁটোপাতা চেটে। রাতে মায়ের পাশে লখা খিদের কষ্ট ভুলে যায়।

এই লখা, ছায়া দেখলে বুক কাঁপে যার, সে আজ ভোররাতে মায়ের পাশ থেকে উঠে পড়ল। মা মুখ হাঁ করে ঘুমুচ্ছে। লখা চুপি চুপি পা ফেলে হারিয়ে গেল ধোঁয়া-ধোঁয়া কুয়াশার মধ্যে।

খানিকটা এগিয়ে উঁচু রেললাইন যেন দুটো মরা সাপ। পাশাপাশি শুয়ে আছে চুপচাপ। লখা ইটের টুকরো দিয়ে ইস্পাতের লাইনে ঠুক-ঠুক ঠুকে তার উপর কান পাতল। হ্যাঁ, শব্দ শোনা যাচ্ছে। যেন গানের সুরলহরি বয়ে যাচ্ছে কানের ভিতর দিয়ে। লখা ভারি মজার দুষ্টু ছেলে। গানের মজা ফুরিয়ে গেলে পর এক লাফে লাইন পেরিয়ে ওপারে পৌঁছে গেল। সেখানে মস্ত নিচু খাদ। তার ভিতর গড়িয়ে পড়লে হাত-পা ভাঙবে নির্ঘাত। খুব সাবধানে খাদ পেরিয়ে ওপারের ডাঙায় উঠে এলো সে। ডাঙাটা আসলে বনজঙ্গলে অন্ধকার। ঝিঁঝি পোকা ডাকছে আর ধেড়ে ধেড়ে গাছের ঝাঁকড়া ছায়া মাথা নেড়ে নেড়ে ভয় দেখাচ্ছে লখাকে।

খচ করে কাঁটা ঢুকে গেল বাঁ পায়ে। কীসের কাঁটা? হবে হয়তো বাবলা-টাবলার। লখা উবু হয়ে বসে কাঁটাটা খসিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলে দিলো। কিন্তু বিষ তো যায় না। কী অসহ্য যন্ত্রণা! আঁ আঁ বলে কেঁদে দিল লখা। কিন্তু কাঁদলে তো চলবে না। সময় নেই আর। তাকে যে যেতেই হবে। আবছা অন্ধকার। ফিনফিনে ঠান্ডা।

গাছের পাতা বেয়ে শিশির গড়িয়ে পড়ছে। খুক খুক করে কাশি আসছে লখার। খালি গা শিশিরে ভিজে শীত লাগছে। একটা ছ্যাঁচড়া ডাল লখার হাফপ্যান্টটা টেনে ধরেছে পিছন দিক দিয়ে। প্যান্ট আধখসা অবস্থায় দৌড়াতে লাগল সে।

একটা খেঁকশেয়াল বুঝি তাকিয়ে দেখছিল তাকে। দেখুক গে। এখন ভয় ভয় করলে দেরি হয়ে যাবে। কাজেই এবার চোখ-কান বুজে দৌড় শুরু করতে হলো তাকে। আর শেষটায় সেই অদ্ভুত গাছটার নিচে পৌঁছে গেল লখা, যার ডালে ডালে রক্তের মতো টুকটুকে লাল ফুল। দিনের বেলায় রেললাইনের উপর দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে থোকা থোকা ফুলের লাল ঝুঁটির পানে তাকিয়ে থাকে সে। এখন ওই উপরের এক থোকা ফুল তার পেড়ে আনা চাই।

হাতের মুঠো পাকিয়ে মনটাকে শক্ত করে নিল লখা। তারপর চড় চড় করে গাছে উঠে গেল। একেবারে কাঠবেড়ালির বাচ্চা যেন। মগডালের কাছাকাছি এসে কয়েকটা তুলোমিঠের মতো বড়ো বড়ো থোকা পেয়ে গেল সে। শিশিরে ভেজা তুলতুলে। তা হোক, তোমরা এখন আমার। নাও সব টুপটাপ নেমে এসো তো আমার মুঠোর মধ্যে। কষ্ট লাগছে। আহা! কীসের কষ্ট? এই তো একটু পরে আমি তোমাদের এমন একটা উঁচু জায়গায় নিয়ে রেখে দেবো, যেখান অবধি তোমরা এই গাছের মগডালে কোনোদিন উঠতে পারবে না। এসো, এসো, লক্ষ্মীসোনারা সব নেমে এসো তো।

ফুল নিয়ে যখন মাটিতে নেমে এলো লখা, তখন সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। কনুই ও বুকে চটচটে ঠান্ডা। হাত দিয়ে টের পায়, টাটকা রক্ত। গাছের ডালপালা কাঁটায় ভর্তি। গা-হাত-পা ছিঁড়ে গেছে আঁচড় লেগে। তাতে কী! জিতে গেছি আমি। গর্বে বুক ফুলে ওঠে লখার।

সেদিন সকাল ছিল বড় আশ্চর্য সুন্দর। আকাশে হালকা কুয়াশা। অল্প অল্প শীত। আর দক্ষিণের সামান্য বাতাস। পথে পথে মিছিলের ঢল নেমেছে। শত শত মানুষ। হাতে ফুলের গুচ্ছ। ঠোঁটে প্রভাতফেরির গান। ধীর পায়ে শহিদ মিনারের দিকে এগিয়ে চলেছে। এই ভিড়ের মধ্যে ক্ষুদে টোকাই লখাকে ঠিকই দেখা যাচ্ছে। তাকে চিনতে কষ্ট হয় না। কারণ মিছিলের সবার গায়ে চাদর, কোট, সোয়েটার। শুধু তার গা খোলা উদাম, গাঢ় কালো। হাত উপচে পড়ছে রক্তলাল ফুলের গুচ্ছ। মিছিলে পা মিলিয়ে সেও চলেছে শহিদ মিনারে ফুল দিতে। সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়ে চলছে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি? কিন্তু তার গলা দিয়ে কথা তো ফোটে না, শুধু শব্দ হয় আঁ আঁ আঁ আঁ।
আসলে কথা ফুটবে কী করে! লখা যে জন্মবোবা। বাংলা বুলি তার মুখে ফুটতে পায় না। সে মনে মনে বলে অআকখ। বাইরে শব্দ হয় - আঁ আঁ আঁ আঁ।

common.content_added_by

শব্দার্থ ও টীকা

57
57

শান - পাথর। এখানে কংক্রিটে তৈরি ফুটপাথ বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে।
ত্যানাখানি - পুরোনো ছেঁড়া কাপড়।
ভিখ - ভিক্ষা, খয়রাত।
মেঙে - চেয়ে।
গুলি খেলা - মার্বেল দিয়ে খেলা।
ছায়া দেখলে বুক কাঁপে যার - যে নিজের ছায়াকেও ভয় পায়। খুব ভীতু।
বিষ - যে পদার্থ শরীরে ঢুকলে যে কোনো প্রাণী অসুস্থ হয়, কখনো কখনো মারাও যায়। এখানে পথে কাঁটা ফোটার জন্য 'ব্যথা' অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
তুলোমিঠে - তুলোর মতো দেখতে মিষ্টি খাদ্য বিশেষ। একে 'হাওয়াই মিঠাই' ও বলে।
মগডাল - গাছের সবচেয়ে উঁচু ডাল।
গাঢ় - ঘন।
প্রভাতফেরি - ভোরবেলা দল বেঁধে পাড়ায় পাড়ায় গান গেয়ে সবাইকে জাগিয়ে তোলার অনুষ্ঠান বিশেষ। কিন্তু বাংলাদেশে প্রভাতফেরি একটি বিশেষ অর্থ বহন করে। ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবিতে আন্দোলন হয়। তখন ছিল পাকিস্তান। তখনকার সরকার সে-দাবি মানেনি। তখন ছাত্র-জনতা তীব্র আন্দোলন করতে থাকে। সেই আন্দোলন চরমে ওঠে ১৯৫২ সালে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে তৎকালীন সরকারের পুলিশ গুলি চালায়। তাতে শহিদ হন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে। তারই স্মরণে প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরি করা হয়। প্রভাতফেরির সময় সকলের কণ্ঠে থাকে আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত এবং শহিদ আলতাফ মাহমুদের সুর করা গান 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি'।
শহিদ মিনার - শহিদের স্মৃতি রক্ষার জন্য নির্মিত মিনার। ভাষা-আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সন্নিকটে আমাদের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার অবস্থিত।

common.content_added_by

পাঠের উদ্দেশ্য

63
63

ভাষা-আন্দোলনের চেতনায় শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা।

common.content_added_by

পাঠ-পরিচিতি

46
46

গল্পটিতে একুশে ফেব্রুয়ারির অবিনাশী প্রভাবের কথা বলা হয়েছে। অতি সাধারণ এক কিশোর লখা। কথা বলতে পারে না সে। কিন্তু তাতে কীই-বা আসে যায়। লখা উঁচু ডালে উঠে লাল ফুল সংগ্রহ করে শহিদ মিনারে যায় শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। কথা বলতে না পারলেও তার মুখ দিয়ে আঁ আঁ আঁ আঁ ধ্বনির মধ্য দিয়েই বেরিয়ে আসে বাঙালির গর্বের উচ্চারণ- 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি'।

common.content_added_by

কর্ম-অনুশীলন

49
49

বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক আবুবকর সিদ্দিক ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে বাগেরহাট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো 'জলরাক্ষস', 'খরাদাহ', 'একাত্তরের হৃদয়ভস্ম', 'বারুদ পোড়া প্রহর' ইত্যাদি।

common.content_added_by

লেখক-পরিচিতি

46
46

ক. শহিদ দিবসের ওপর শিক্ষার্থীরা আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।
খ. শহিদ দিবস উপলক্ষ্যে ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটিকা ইত্যাদির সমন্বয়ে দেয়ালিকা প্রকাশ করবে।

common.content_added_by

নমুনা প্রশ্ন

110
110

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১. লখা কখন তার খিদের কষ্ট ভুলে যায়-
ক. ঘুমুতে গেলে
খ. মাকে কাছে পেলে
গ. খেলার সঙ্গী পেলে
ঘ. প্রভাতফেরির গান শুনলে

২. লখাকে চোখ-কান বুজে দৌড় শুরু করতে হলো, কারণ-
ক. সে ভয় পেয়েছিল
খ. বাইরে অন্ধকার ছিল
গ. তাকে ফুল আনতে হবে
ঘ. মায়ের কাছে ফিরে যেতে হবে

উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও।
বাবার সাথে প্রভাতফেরিতে এসেছে দিপু। ওর হাতে একটা টকটকে লাল গোলাপ। ওর কন্ঠে গানের সুর 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো'। ও লাল গোলাপটিকে শহিদ মিনারের সবচেয়ে উঁচু সিঁড়িতে রাখতে চায়।
৩. লখা ও দিপুর মধ্যে যে বিষয়ে মিল আছে তা হলো-
ক. শহিদ মিনারে আসা মানুষ দেখার ইচ্ছা
খ. শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আবেগ
গ. প্রতিবন্ধকতা দূর করার অদম্য বাসনা
ঘ. শহিদ দিবসের গান গাওয়ার আগ্রহ

৪. দিপু ও লখা দুজনেই শহিদ দিবস উদযাপন করেছিল; তবু লখাই প্রমাণ করেছে যে-
i. ভালোবাসার অনুভূতি প্রতিবন্ধকতার চেয়ে শক্তিশালী
ii. আত্মবিশ্বাস দ্বারা বাধাকে অতিক্রম করা যায়
iii. শিশুরা অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. iও ii
খ. iও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii

সৃজনশীল প্রশ্ন

১. ইশতিয়াক এবার বৃত্তি নিয়ে জাপানে লেখাপড়া করতে চলে আসায় শহিদ দিবস উদ্যাপন করতে পারবে না। অথচ প্রতিবছর সে প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ করত- বক্তৃতা, আবৃত্তি, আলোচনা শুনত, সে-কথা মনে করে তার চোখ জলে ভরে আসে। মনে মনে কিছু করার জন্য ইচ্ছা পোষণ করে। অতঃপর ইশতিয়াক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও এর ইতিহাস সহপাঠীদের কাছে তুলে ধরার পরিকল্পনা করে।
ক. লখা রাতে কোথায় ঘুমায়?
খ. 'জিতে গেছি আমি। গর্বে বুক ফুলে ওঠে লখার।'- কথাটি দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে?
গ. 'লখা ও ইশতিয়াক দুজনের কাছে শহিদ দিবস ভিন্ন আঙ্গিকে এসেছে।'- ব্যাখ্যা কর।
ঘ. 'ইশতিয়াকের শহিদ দিবস উদ্যাপনের আকাঙ্ক্ষা লখার শহিদ দিবস উদ্যাপনের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন।'- বিশ্লেষণ কর।

common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion