প্রস্বেদন (Transpiration) (6.2.4)

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - জীববিজ্ঞান (নতুন সংস্করণ) জীবে পরিবহণ | - | NCTB BOOK
142
142

পানি ছাড়া জীবন কল্পনা করা যায় না। উদ্ভিদ প্রধানত মূল দিয়ে তার প্রয়োজনীয় পানি শোষণ করে। শোষিত পানির অতি সামান্য অংশ উদ্ভিদের বিভিন্ন জৈবিক কার্যাবলির জন্য ব্যয় হয়। অবশিষ্ট পানি উদ্ভিদের বায়বীয় অংশ দিয়ে বাষ্পাকারে বাইরে বের হয়ে যায়। সাধারণত স্থলজ উদ্ভিদ যে শারীরতত্ত্বীয় প্রক্রিয়ায় তার বায়বীয় অঙ্গের মাধ্যমে বাষ্পাকারে পানি বের করে দেয়, সেটাই প্রস্বেদন বা বাষ্পমোচন প্রক্রিয়া। এ কাজটি তার বায়বীয় অঙ্গের কোন অংশের মাধ্যমে ঘটে, তার ভিত্তিতে এদের তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা: পত্ররন্ধ্রীয় প্রস্বেদন, কিউটিকুলার প্রস্বেদন ও লেন্টিকুলার প্রস্বেদন।

(a) পত্ররন্দ্রীয় প্রস্বেদন (Stromatal transpiration)
পাতায়, কচিকান্ডে, ফুলের বৃতি ও পাপড়িতে দুটি রক্ষীকোষ (Guard cell) বেষ্টিত এক ধরনের রস্তু থাকে। এদেরকে পত্ররন্দ্র (একবচন stoma, বহুবচন stomata) বলে। কোনো উদ্ভিদের মোট প্রস্বেদনের 90-95% হয় পত্ররস্থের মাধ্যমে।

(b) কিউটিকুলার প্রনেদন (Cuticular transpiration)
উদ্ভিদের বহিঃত্বকে বিশেষ করে পাতার উপরে এবং নিচে কিউটিনের আবরণ থাকে। এ আবরণকে কিউটিকল বলে। কিউটিকল ভেদ করে কিছু পানি বাষ্পাকারে বাইরে বের হয়। এ প্রক্রিয়াকে কিউটিকুলার প্রস্বেদন বলে।
(c) লেন্টিকুলার প্রস্বেদন (Lenticular transpiration):
উদ্ভিদে গৌণ বৃদ্ধি হলে কাণ্ডের বাকল ফেটে লেন্টিসেল নামক ছিদ্র সৃষ্টি হয়। লেন্টিসেলের ভিতরের কোষগুলো আলাদাভাবে সজ্জিত থাকে এবং এর মাধ্যমে কিছু পানি বাইরে বেরিয়ে যায়। একে লেন্টিকুলার প্রস্বেদন বলে।

প্রস্বেদনের ফলে উদ্ভিদটি বাষ্পাকারে অতিরিক্ত পানি মুক্ত করে আর এর ফলে সৃষ্ট টানে পানি শোষিত হয়। এ প্রক্রিয়াটি অনেকগুলো প্রভাবকের উপর নির্ভরশীল। এদের মোটামুটিভাবে দুভাগে ভাগ করা যায়, বাহ্যিক প্রভাবক ও অভ্যন্তরীণ প্রভাবক।

(a) বাহ্যিক প্রভাবক
(i) তাপমাত্রা (Temperature): তাপমাত্রার তারতম্যের সঙ্গে প্রস্বেদনের হারও ওঠা-নামা করে।
অধিক তাপে পানি সহজেই বাষ্পে পরিণত হতে পারে বলে প্রস্বেদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে বায়ুমণ্ডলের জলীয়বাষ্প ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রস্বেদনের হারও দ্রুততর হয়। তাপমাত্রা কমে গেলে তাই স্বাভাবিক নিয়মেই প্রস্বেদনের হারও কমে যায়।
(ii) আপেক্ষিক আর্দ্রতা (Relative humidity): বায়ুতে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ ও বায়ুর জলীয়বাষ্প
ধারণক্ষমতার আনুপাতিক হারকে আপেক্ষিক আর্দ্রতা বলে। কোনো একটি এলাকার বায়ুমণ্ডলে অধিক জলীয়বাষ্প থাকা সত্ত্বেও অধিক ধারণক্ষমতার জন্য তা শুষ্ক হতে পারে। আবার কম জলীয়বাষ্প থাকা সত্ত্বেও বায়ুমণ্ডলের কম ধারণক্ষমতার জন্য এটি সিক্ত হতে পারে। আপেক্ষিক আর্দ্রতা কম হলে বায়ু অসম্পৃক্ত থাকে ও জলীয়বাষ্প গ্রহণ করতে পারে কিন্তু অধিক হলে বায়ু সম্পৃক্ত হওয়ার ফলে জলীয়বাষ্প ধারণক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আপেক্ষিক আর্দ্রতা কম থাকলে প্রস্বেদনের হার বেড়ে যায় এবং বেশি থাকলে হার কমে যায়।
(iii) আলো (Light): আলোর উপস্থিতিতে পত্ররন্ধ্র খুলে যায়, ফলে প্রস্বেদনের হার বৃদ্ধি পায়।
কিন্তু অন্ধকারে পত্ররন্ধ্র বন্ধ থাকায় এই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। আলোর তারতম্যের জন্য পত্ররন্ধ্রের আকারেও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। ফলে প্রস্বেদনের হারও ওঠা-নামা করে। আলো উদ্ভিদদেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমেও প্রস্বেদন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
(iv) বায়ুপ্রবাহ (Wind): প্রস্বেদনের ফলে উদ্ভিদের চারদিকের বায়ু সিক্ত হয়ে ওঠে, ফলে এই
প্রক্রিয়ার হার কমতে থাকে। যখন বায়ুপ্রবাহ সম্পৃক্ত বায়ু দূরে সরিয়ে দেয় তখন এই হার আবার বৃদ্ধি পায়। বায়ুপ্রবাহের ফলে পত্রগুলো আন্দোলিত হয় এবং পত্ররন্ধ্রে চাপ পড়ে। ফলে অধিক হারে জলীয়বাষ্প রন্দ্রপথে বের হয়। এসব কারণে বায়ুপ্রবাহের তারতম্যে প্রস্বেদন হারেরও তারতম্য ঘটে। বায়ুচাপ বৃদ্ধিতে বাষ্পীয়ভবন ক্রিয়া হ্রাস পায়, ফলে প্রস্বেদন কমে যায়। আবার বায়ুচাপ কমে গেলে বাষ্পীয়ভবন প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পায় এবং প্রস্বেদনের হারও বেড়ে যায়।
(b) অভ্যন্তরীণ প্রভাবক
(i) পত্ররন্ধ্র: পত্ররন্দ্রের সংখ্যা, আয়তন, গঠন এবং অবস্থানের উপর প্রস্বেদন হারের তারতম্য ঘটে।
(ii) পত্রের সংখ্যা: পাতার সংখ্যা, আয়তন, গঠন এবং অবস্থানের উপর প্রস্বেদন হারের তারতম্য লক্ষ করা যায়।
(iii) পত্রফলকের আয়তন: পত্রফলকের আয়তন বড় হলে প্রস্বেদনের হার বেড়ে যায়। একইভাবে এ আয়তন কম হলে প্রস্বেদনের হারও কমে যায়।
(iv) উদ্ভিদের বায়ব অঙ্গের আয়তন: পাতা ও কাণ্ডসহ উদ্ভিদের বায়ব অঙ্গের কলেবর বৃদ্ধি পেলে প্রস্বেদনের হারও বেড়ে যায়।এছাড়া কিউটিকলের উপস্থিতি, স্পনজি প্যারেনকাইমার পরিমাণ এগুলোও প্রস্বেদন হারের তারতম্য ঘটায়।

একক কাজ
কাজ: প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ যে পানি বাষ্পাকারে বের করে দেয় তার পরীক্ষা।
উপকরণ: টবসহ একটি সতেজ উদ্ভিদ, একটি কাচের বেলজার বা সেলোফেন ব্যাগ, সুতা বা ক্লিপ এবং পরিমাণমতো কিছু পানি।
পদ্মতি: প্রথমেই টবসহ গাছটিকে টেবিলের উপর বসিয়ে দিতে হবে এবং টবে পরিমাণমতো পানি ঢেলে দিতে হবে। এবার কিছু পাতাসহ একটি শাখাকে সেলোফেন ব্যাগ দিয়ে মুড়ে সুতা দিয়ে বেঁধে বা ক্লিপ দিয়ে আটকে অথবা বেলজ্জার দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন ভিতরের বাষ্প বের হতে বা বাইরের বাতাস ঢুকতে না পারে। এ অবস্থায় টবটি এক ঘণ্টা রেখে দিতে হবে।

পর্যবেক্ষণ: এক ঘণ্টা পর দেখা যাবে, সেলোফেন ব্যাগের ভিতরের পায়ে পানির ফোঁটা জমে আছে এবং পুরো ব্যাগটি অস্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। কেন এমন হলো তা কি তোমরা বুঝতে পারছ?
সিদ্ধান্ত: যেহেতু সেলোফেন ব্যাগে অন্য কোনো পানি ঢোকার সুযোগ ছিল না, তাই ঐ পানির কণাগুলো যে পাতা থেকেই বেরিয়েছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এতে প্রমাণিত হলো যে উদ্ভিদ তার বায়বীয় অঙ্গ দিয়ে পানি বাষ্পাকারে দেহের বাইরে বের করে দেয়।

সতর্কতা:
(a) টবের উদ্ভিদটি অবশ্যই সতেজ হতে হবে।
(b) সেলোফেন ব্যাগের মুখ ভালোভাবে বেঁধে বায়ুরোধী করতে হবে।

প্রস্বেদন একটি অতি প্রয়োজনীয় অমঙ্গল (Transpiration is a necessary evil) প্রস্বেদনের গুরুত্ব সম্পর্কে বর্তমানে সকল বিজ্ঞানীই ঐকমত্যে পৌঁছেছেন বলে মনে করা হয়। এ প্রক্রিয়ার উপরে সজীব উদ্ভিদ কোষের বিপাকীয় কার্যক্রম অনেকাংশে নির্ভরশীল। প্রস্বেদনের ফলে জাইলেমবাহিকায় টান পড়ে। এই টানের ফলে উদ্ভিদের মূলরোম কর্তৃক শোষিত পানি এবং খনিজ লবণ পাতায় পরিবাহিত হয়। এ টানের ঘাটতি হলে পানি শোষণ কমে যাবে এবং খাদ্য প্রস্তুতসহ অনেক বিপাকীয় কার্যক্রম শ্লথ হয়ে যাবে। প্রস্বেদনের ফলে পাতার মেসোফিলে ব্যাপন চাপ ঘাটতি সৃষ্টি হয়, যা পানি শোষণে সাহায্য করে। উদ্ভিদ প্রস্বেদনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত পত্রফলক দিয়ে শোষিত তাপশক্তি হ্রাস করে পাতার কোষগুলোর তাপমাত্রা সহনশীল পর্যায়ে রাখে।
অন্যদিকে, গুরুত্বপূর্ণ এই প্রক্রিয়াটি উদ্ভিদের বহু ধরনের উপকার করলেও এর কিছু অপকারী ভূমিকাও রয়েছে। যেমন: পানি শোষণের চেয়ে প্রস্বেদনে পানি হারানোর হার বেশি হলে উদ্ভিদের জন্য পানি এবং খনিজের ঘাটতি দেখা দিবে। এর ফলে উদ্ভিদটির মৃত্যু হতে পারে। মাটিতে পানির ঘাটতি থাকলে শোষণ কম হবে কিন্তু প্রস্বেদন পূর্বের মতো চলতে থাকবে। এ অবস্থাকে ঠেকাতে প্রকৃতি শীত মৌসুমে বহু উদ্ভিদের পাতা ঝরিয়ে দেয়। প্রস্বেদনের অভাবে প্রয়োজনীয় ব্যাপন চাপ ঘাটতি হবে না, ফলে অভিস্রবণ কম হবে।
এমতাবস্থায় বলা যায়, প্রস্বেদন কিছু ক্ষতিসাধন করলেও এই প্রক্রিয়া উদ্ভিদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটি কার্যক্রম। বৈশিষ্ট্যের বৈপরীত্যের জন্য বিজ্ঞানী কার্টিস প্রস্বেদনকে 'প্রয়োজনীয় ক্ষতি' (Necessary Evil) নামে অভিহিত করেছেন। তবে সার্বিক বিচারে এটি উদ্ভিদকে টিকে থাকার ক্ষেত্রে সুবিধা দেয় বলে এর অপকারী দিক থাকা সত্ত্বেও প্রস্বেদন প্রক্রিয়া বিবর্তিত হয়েছে।

common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion