কিং লিয়ার (উইলিয়াম শেক্সপিয়র রূপান্তর: জাহানারা ইমাম)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - আনন্দপাঠ - | NCTB BOOK
81
81

ব্রিটেনের রাজা লিয়ার বৃদ্ধ হয়েছেন। তিনি স্থির করেছেন, তাঁর রাজ্য তিন ভাগে ভাগ করে তিন মেয়েকে দান করবেন। বড়ো দুই মেয়ে গনেরিল ও রিগানের বিয়ে হয়েছে আলবেনির ডিউক ও কর্নওয়ালের ডিউকের সঙ্গে। ছোটো মেয়ে কর্ডেলিয়া এখনো কুমারী। ফ্রান্সের রাজকুমার এবং বার্গান্ডির ডিউক- এই দুজনই কর্ডেলিয়ার পাণিপ্রার্থী হয়ে ব্রিটেনে এসেছে। রাজা লিয়ার তাঁর রাজদরবারে আজ সবাইকে ডেকেছেন। তিন মেয়ে, দুই জামাই, কর্ডেলিয়ার দুই পাণিপ্রার্থী, গ্লস্টারের আর্ল, কেন্টের আর্ল এবং আরো অনেকে উপস্থিত হয়েছেন রাজা কী বলেন, তা শোনার জন্য।

রাজা সবাইকে উদ্দেশ করে বললেন, 'বৃদ্ধ বয়সে রাজ্য-শাসনের ঝক্কি-ঝামেলা আমার ভালো লাগে না। আমার কন্যা-জামাতাদের ওপর এই ভার ছেড়ে দিয়ে আমি শান্তিতে শেষদিনের প্রতীক্ষায় থাকতে চাই। এখন আমি আমার কন্যাদের মুখ থেকে শুনতে চাই, আমাকে কে কতখানি ভালোবাসে। গনেরিল, তুমি আমার বড়ো মেয়ে, তুমিই প্রথমে বলো।' গনেরিল বলল, 'পিতা, আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা আমি কথায় প্রকাশ করতে অক্ষম। এই পৃথিবীতে যা কিছু মহান, সুন্দর, জীবনের যা কিছু কাম্য, আরাধ্য সবকিছুর চেয়ে, আমার এই দুই চোখের জ্যোতির চেয়ে, আমার সমগ্র জীবনের চেয়ে আপনাকে বেশি ভালোবাসি।'

বড়ো বোনের কথা শুনে কর্ডেলিয়া মনে মনে বলল, কর্ডেলিয়া তুমি তা হলে কী করবে? তুমি তো অমন করে ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বলতে পারবে না। ভালোবেসে নীরবেই থেকো তুমি। গনেরিলের কথা শুনে রাজা খুব সন্তোষ প্রকাশ করে তাকে রাজ্যের সেরা এক-তৃতীয়াংশ দান করলেন। তারপর মেজো মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'এবার তুমি কী বলো?' রিগান বলল, 'আমার বড়ো বোন দেখি আমারই মনের কথাগুলো সব বলে দিয়েছে। তবে একটা কথা সে বলতে পারেনি, তা হলো আপনার ভালোবাসা ছাড়া আমার জীবনের অন্যসব সুখ-আনন্দ তুচ্ছ।' শুনে কর্ডেলিয়া আরেকবার মনে মনে হায় হায় করল, বেচারি কর্ডেলিয়া। তুমি তো ওদের মতো মুখ ফুটে বলতে পারবে না। কিন্তু তাই বলে তোমার ভালোবাসা কারো চেয়ে কম নয়; বরং তা এত গভীর যে জিভের ডগায় আনলে তার মর্যাদাহানি হবে।

রাজা রিগানের প্রশস্তি শুনে পরম হৃষ্টচিত্তে তাকে রাজ্যের অপর এক-তৃতীয়াংশ দান করলেন। এবার কর্ডেলিয়ার পালা। রাজা লিয়ার তিন মেয়ের মধ্যে কর্ডেলিয়াকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। কর্ডেলিয়া যেন তাঁর চোখের মণি। কিন্তু এখন কর্ডেলিয়া যা বলল, তা শুনে রাজা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কর্ডেলিয়া বলল, 'পিতা, আমার মনের কথা মুখে আনতে পারছি না। তার জন্য আমার অশান্তির সীমা নেই। একটি মেয়ের তার পিতাকে যতখানি ভালোবাসা কর্তব্য, ঠিক ততখানিই আপনাকে ভালোবাসি। তার বেশিও নয়, কমও নয়।'
অপমানে রাজা লিয়ারের মুখ কালো হয়ে গেল, তিনি বললেন, 'কথাটা ঘুরিয়ে নাও কর্ডেলিয়া, নইলে তোমারই ক্ষতি।'

কী বলব পিতা! আপনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন, লালন করেছেন, ভালোবেসেছেন। প্রতিদানে আমি আপনাকে ভালোবাসি, মান্য করি, সম্মান করি।
আমার বোনেরা যে বলেছে তাদের সবটুকু ভালোবাসা আপনাকেই দিয়েছে, তা হলে তাদের স্বামীদের জন্য কী রেখেছে? আমার বিয়ে হলে আমার স্বামীকেও তো আমি ভালোবাসব। তখন কি পিতার প্রতি কন্যার ভালোবাসা ও কর্তব্য ভাগ হয়ে যাবে না? সেটাই তো স্বাভাবিক। অতএব বোনদের মতো করে আমি বলতে পারব না।
রাজা লিয়ার অপমানে, ক্রোধে অস্থির হয়ে বললেন, 'তুমি সত্যি সত্যি বলছ?'
'হ্যাঁ, পিতা, সত্যি সত্যি।'

'এত কম তোমার বয়স, এখনই এমন কঠিন তোমার মন?'
'বয়স আমার কম বটে, তবে যা সত্য, তা-ই বলছি।'
ক্রোধে, অপমানে, দুঃখে রাজার মুখ থমথম করতে লাগল, তিনি ভয়ংকর স্বরে বললেন, 'তুমি তাহলে তোমার সত্য নিয়েই থাকো। এই মুহূর্তে আমি তোমাকে ত্যাজ্যকন্যা করলাম। আজ থেকে তুমি আমার কেউ নও। আমিও তোমার কেউ নই। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাও তুমি।'
বিষম ক্রোধে রাজা তাঁর রাজ্যের বাকি অংশ- যেটা কর্ডেলিয়ার জন্য রেখেছিলেন, সেটা বড়ো দুই মেয়েকে ভাগ করে দিলেন। তিনি শুধু রাজা নামটা নিজের জন্য রাখলেন, কিন্তু রাজ্য শাসনের যাবতীয় দায়িত্ব দুই জামাতার ওপর ন্যস্ত করলেন। তিনি বললেন, এখন থেকে তিনি মাত্র এক শত জন যোদ্ধারক্ষী সঙ্গে রাখবেন। এবং পালাক্রমে এক মাস করে গনেরিল ও রিগানের কাছে বাস করবেন।

যে বিষয়টা আনন্দোৎসবের ভিতর দিয়ে শুরু হয়েছিল, তার এরকম ভয়াবহ পরিণতি দেখে রাজা লিয়ারের সভাসদবর্গ সকলে বিস্মিত, হতচকিত হয়ে গেলেন। কর্ডেলিয়ার জন্য দুঃখে তাঁরা মুহ্যমান হলেও ভয়ে কেউ রাজার সামনে কোনো প্রতিবাদ করতে পারলেন না। ভয় পেল না শুধু আর্ল অব কেন্ট। রাজার সভাসদবর্গের মধ্যে কেন্টই সবচেয়ে বিশ্বস্ত। লিয়ারের প্রতি তার অগাধ ভক্তি। লিয়ার তার কাছে পিতৃতুল্য। সে নির্ভীক কন্ঠে, কর্ডেলিয়ার প্রতি রাজার এই অবিচারের প্রতিবাদ করল, 'এ আপনি কী করছেন রাজা? কর্ডেলিয়া যে আপনাকে কম ভালোবাসে না, সেটা কি বুঝতে পারছেন না? অন্তঃসারশূন্য তোষামোদবাক্যই আপনার কাছে বেশি মূল্য পেল?'

রাজা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, 'যদি বাঁচতে চাও, তাহলে চুপ থাকো।'
'আমার এ জীবন আপনার সেবাতেই উৎসর্গ করা। আপনি তা নিলে নিয়ে নেবেন। আমার ভয় কীসের?'
রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে তখনই কেন্টকে নির্বাসন-দণ্ড দিলেন। ছয় দিনের মধ্যে তাকে এ রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হবে। কর্ডেলিয়া এখন কপর্দকশূন্য, নিরাশ্রয়। এই অবস্থায় বার্গান্ডির ডিউক তাকে বিবাহ করতে চাইল না। কারণ, রাজত্ব ছাড়া রাজকন্যার কোনো মূল্য নেই তার কাছে। ফ্রান্সের যুবরাজ কিন্তু রাজার স্নেহ এবং তার রাজত্ব থেকে বঞ্চিত কর্ডেলিয়াকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করবে বলে জানাল। কারণ, সে বুঝে গেছে, কর্ডেলিয়া রমণীকুলে রত্নস্বরূপ। সে স্বার্থসাধনের জন্য তোষামোদের বাক্য সাজিয়ে কাউকে খুশি করতে পারে না, কিন্তু তার অন্তরে প্রজ্জ্বলিত প্রেম, প্রীতি, কর্তব্যজ্ঞান সম্বন্ধে সে সচেতন, সৎ। এ রকম রমণীকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া ভাগ্যের কথা। সে কর্ডেলিয়াকে বলল, 'আমি তোমার মতো গুণবতী-রূপবতী রমণীকে পেয়ে ধন্য। তুমি একই সঙ্গে আমার মনের রানি এবং আমার দেশেরও রানি হয়ে নিশ্চয় সুখী হবে। যদিও তোমার পিতা তোমার প্রতি এই রকম নিষ্ঠুর ও অমানবিক ব্যবহার করেছেন, তবুও তুমি তাঁর কাছে বিদায় নিয়ে এসো।'

কর্ডেলিয়া অশ্রুপূর্ণ নয়নে প্রথমে পিতা ও পরে ভগ্নিদ্বয়ের কাছে বিদায় নিয়ে ফ্রান্সের যুবরাজের সঙ্গে চলে গেল।

গনেরিলের কাছে কয়েক সপ্তাহ থাকার পরই রাজা লিয়ার টের পেতে লাগলেন মেয়ের কথা ও কাজের মধ্যে কী আকাশ-পাতাল প্রভেদ। গনেরিল পিতার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না, পিতার অনুচর যোদ্ধারক্ষীদের কার্যকলাপের খুঁত ধরে, গনেরিলের কাজের লোকেরা রাজাকে যথাযোগ্য সম্মান করে না। এতে প্রতিপদেই লিয়ারের মেজাজ খারাপ হতে লাগল। রাজা দিশেহারা হয়ে গেলেন। এ কী কাণ্ড! যে মেয়ে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে তাঁকে বলেছে, তার জীবনের চেয়েও বেশি তাঁকে ভালোবাসে, যাকে তিনি তাঁর রাজ্যের অর্ধেক দান করেছেন, রাজমুকুট পর্যন্ত জামাতার মাথায় বসিয়েছেন, সেই আদরের মেয়ের এখন এ কী ব্যবহার, এ কী কটু কথা! রাজাকে যেন সে সহ্যও করতে পারছে না। রাজার একশ জন যোদ্ধা-সহচরকে সে উৎপাত বলে মনে করছে। সে কি-না পিতার মুখের ওপরই বলে দিল, তাঁর এতগুলো রক্ষী-অনুচরের কোনো প্রয়োজনই নেই।

বিষম ক্রোধে লিয়ার জ্যেষ্ঠ কন্যাকে অনেক তিরস্কার করলেন। তারপর অশ্ব প্রস্তুত করতে বললেন। তিনি আর একমুহূর্ত এই অকৃতজ্ঞ কন্যার প্রাসাদে থাকবেন না। তাঁর আরো একটি মেয়ে আছে। তিনি রিগানের কাছে চলে যাবেন। সেই মর্মে একটি চিঠি লিখে তিনি কাইয়াসকে দিয়ে রিগানের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

কিন্তু গনেরিলও কম যায় না। সেও তড়িঘড়ি রিগানকে একটি চিঠি পাঠাল। তাতে লিখল, রাজা লিয়ার বৃদ্ধ বয়সে কী রকম অবিবেচক, বদমেজাজি এবং উপদ্রবম্বরূপ হয়ে উঠেছেন। তাঁর একশ জন যোদ্ধা-সহচরও গনেরিল এবং রিগানের পক্ষে হুমকিস্বরূপ। রিগান যেন লিয়ারকে কোনোভাবেই পাত্তা না দেয় এবং তাঁর রক্ষীসংখ্যা কমাবার জন্য যেন চাপাচাপি করে।

গনেরিল এই চিঠি পাঠিয়েই ক্ষান্ত রইল না, সে নিজেও রিগানের কাছে চলে গেল। রাজা লিয়ার রিগানের প্রাসাদে এসে দেখেন, বোনের হাত ধরে গনেরিল সেখানে উপস্থিত। রিগান স্থির কণ্ঠে পিতাকে জানাল, সে এখন লিয়ার এবং তাঁর একশ রক্ষীকে সমাদর করার জন্য প্রস্তুত নয়। লিয়ারের উচিত রক্ষীসংখ্যা কমিয়ে অর্ধেক করে বড়ো মেয়ের কাছে ফিরে যাওয়া এবং নির্ধারিত সময়টুকু সেখানেই কাটানো। রাজা লিয়ারের পরিচিত জগৎ তাঁর চোখের সামনেই উল্টে গেল। এ কী কথা তিনি শুনছেন তাঁর দ্বিতীয় কন্যার মুখে! এই মেয়ে দুটিই কি তাঁকে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে পৃথিবীর সর্বোত্তম ভালোবাসার কথা শুনিয়েছিল? সেই একই মেয়ে দুটিই কি এই রকম নিষ্ঠুর বাক্য কঠিন মুখ করে শোনাচ্ছে? ক্রোধে, দুঃখে, অপমানে রাজা লিয়ার উপলব্ধি করলেন, তাঁর জীবদ্দশাতেই এভাবে রাজ্য বিলিয়ে দিয়ে, ক্ষমতা হস্তান্তর করে তিনি কী ভুল করেছেন। সেই সঙ্গে উপলব্ধি করলেন, কর্ডেলিয়ার প্রতি তিনি কী নিদারুণ অবিচার করেছেন।

রাজার এই রকম দুঃসময়ে তাঁর পাশে যে দুজন বিশ্বস্ত অনুচর রয়েছে, তারা হলো রাজার প্রিয় বিদূষক, যে তাঁকে সব সময় মজার মজার কথা বলে হাসায়, আনন্দ দেয়। লিয়ার তাঁর রাজমুকুট জামাতাকে দিয়ে দিলেও বিদূষকটি রাজার পাশ ছাড়েনি। সে রাজাকে যথার্থই ভালোবাসে। আর রয়েছে কাইয়াস নামে এক নবনিযুক্ত ভৃত্য। কাইয়াস আসলে ছদ্মবেশী আর্ল অব কেন্ট। রাজা লিয়ার যদিও তাকে রাজ্য থেকে নির্বাসন দিয়েছিলেন, রাজার প্রতি আনুগত্যবশত কেন্ট রাজাকে ছেড়ে দূরে চলে যেতে পারেনি। রাজা বৃদ্ধ, রাজা খামখেয়ালি, রাজা মেজাজি, তবু তো তিনি রাজাই। কন্যাদের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসার বশে তিনি জীবদ্দশাতে রাজ্য ও রাজমুকুটের দখল ছেড়েছেন, অথচ সেই অকৃতজ্ঞ কন্যারা আজ তাঁকে কী হেনস্তাই না করছে। মেজো মেয়ের কাছ থেকেও এরকম ব্যবহার পেয়ে রাজা প্রায় পাগলের মতো হয়ে গেলেন। সে সময় বাইরে তুমুল ঝড়বৃষ্টি চলছে। রিগান কিছুতেই পিতাকে তার প্রাসাদে প্রবেশ করতে দেবে না। তাঁকে বড়ো মেয়ের কাছেই ফিরে যেতে হবে। রাজা বৃদ্ধ হলেও আত্মমর্যাদাবোধ এখনও হারাননি। তিনি সেই তুমুল ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই প্রান্তরে বেরিয়ে গেলেন।

বঝড়বৃষ্টির রাতে রাজা লিয়ার এক চালাঘরে এসে আশ্রয় নিলেন। সেখানে বসবাসকারী এডগারকে দেখে রাজার বিদূষক প্রথমে ভয় পেয়ে যান। এডগার পাগলের অভিনয় করার জন্য কাপড়চোপড় সব খুলে উলঙ্গ হয়ে কোমরে শুধু একটা কম্বল জড়িয়ে থাকার জন্য বিদূষকটি প্রথমে ভেবেছিল, ওটা একটা ভূত বা প্রেত। পরে এডাগারের কথা শুনে আশ্বস্ত হলো- ওটা নেহাতই একটা পাগল। রাজা লিয়ার তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'তুমিও কি তোমার মেয়েদের সব দান করে দিয়ে এই রকম নিঃস্ব হয়েছ?' মেয়েদের নিষ্ঠুর ব্যবহারে লিয়ারের মন এমনই ভেঙে গিয়েছে যে তিনি উন্মাদ হওয়ার পর্যায়ে চলে গেছেন।

কেন্ট তাঁকে দেখছে আর ভীত হচ্ছে। কী করে রাজাকে এই দুর্দশা থেকে উদ্ধার করবে, সেই চিন্তায় সে অস্থির। সে ইতোমধ্যেই যেসব খবর সংগ্রহ করেছে, তা-ও বেশ বিপজ্জনক। গনেরিল ও রিগানের ষড়যন্ত্রের ফলে লিয়ারের জীবনও এখন আর নিরাপদ নয়। যত শীঘ্র সম্ভব রাজাকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু রাজা যেরকম সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন, তাতে তাঁকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। গ্লস্টার কেন্টের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। তিনি রিগান ও তার স্বামী কর্নওয়ালের নিষেধ অগ্রাহ্য করে রাজাকে তাঁর প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। এ কাজে তাঁকে বেশ বেগ পেতে হলো। কজন অনুচর মিলে রাজাকে বেশ করে ঠেসে ধরে তবে প্রাসাদে আনতে পারল। প্রাসাদের ভিতরে এসে লিয়ার এক কাল্পনিক রাজদরবার বসিয়ে তাঁর বড়ো দুই মেয়ের বিচার করতে শুরু করলেন। তাঁর এই বদ্ধ-উন্মাদ অবস্থা দেখে বিশ্বস্ত আর্ল অব গ্লস্টারের চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠল। তিনি আর্ল অব কেন্টকে বললেন, রাজাকে ডোভারে নিয়ে যেতে। সেখানে অন্তত রাজার প্রাণের ভয় থাকবে না। তারপর সেখান থেকে ফ্রান্সের রানি কর্ডেলিয়াকে সংবাদ প্রেরণ করা মোটেই কঠিন হবে না। কারণ ডোভার ফ্রান্সের কাছাকাছি ব্রিটেনের সীমান্তে অবস্থিত। ডোভারের পরেই ছোটো একটি চ্যানেল পার হয়ে সীমান্ত শুরু হয়।

ওদিকে গনেরিল যখন সংবাদ পেল যে রাজা লিয়ার সীমান্তবর্তী শহর ডোভারে পৌঁছেছেন, তখন সে নিজেদের নিরাপত্তা সম্বন্ধে আতঙ্কিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিল লিয়ারের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে হবে। এই মর্মে সে যখন বোন রিগানের কাছে খবর পাঠাতে যাবে, তখন শুনল ভগ্নিপতি কর্নওয়াল মৃত্যুবরণ করেছে। তখন সে এডমন্ডের সাহায্যে এই যুদ্ধযাত্রার জন্য প্রস্তুত হলো। গনেরিলের স্বামী ডিউক অব আলবেনি সবসময়ই রাজা লিয়ারের প্রতি অনুগত ছিলেন এবং স্ত্রীর এই নিষ্ঠুর আচরণ কখনো সমর্থন করতেন না। তিনি মনে মনে স্থির করলেন রাজা লিয়ারকে সাহায্য করবেন।

ফ্রান্সের রানি কর্ডেলিয়া বেশ সুখ এবং সম্মানের সঙ্গে জীবন-যাপন করছিল। কেবল পিতার কথা মনে হলে তার বুকের ভিতর একটি ব্যথার কাঁটা খচখচ করত। হঠাৎ একদিন সে খবর পেল, তার পিতা খুব কাছে ফ্রান্স-সীমান্তের ওপারেই ডোভারে রয়েছেন। বড়ো দুই বোন কী অমানুষিক নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তাঁকে বিতাড়িত করেছে, কী নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় তিনি উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন- এসব খবরও কর্ডেলিয়ার কানে এল। শুনে তার দুই চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরতে লাগল। তার স্বামী ফ্রান্সের রাজাকে অনুরোধ করল, রাজা যেন তার সঙ্গে কিছু সৈন্য দেন যাতে সে ডোভারে গিয়ে পিতার সঙ্গে মিলিত হতে পারে এবং দুই ব্রোনের সম্মিলিত সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করে তার পিতাকে আবার তাঁর সিংহাসনে বসাতে পারে। ফ্রান্সের রাজা কর্ডেলিয়ার সঙ্গে ডোভার পর্যন্ত এসে আবার জরুরি কাজে ফ্রান্সে ফিরে গেলেন। কর্ডেলিয়া ডোভারের পথে-প্রান্তরে পিতাকে খুঁজে বেড়াতে লাগল। লিয়ার এমনই খামখেয়ালি যে এক জায়গায় তাঁকে স্থিরভাবে রাখা যায় না। তিনি প্রায়ই অনুচরদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ান।

লিয়ার এখনো ঘোর উন্মাদ। কর্ডেলিয়ার লোকজনও রাজাকে সর্বত্র খুঁজছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন মাঠে এসে রাজার দেখা পেল এবং বেশ কায়দা করে রাজাকে নিয়ে গেল কর্ডেলিয়ার শিবিরে। কর্ডেলিয়া চোখের পানি চেপে মমতা ও যত্নের সঙ্গে অসুস্থ পিতার সেবা করতে লাগল। চিকিৎসকের যথাযথ ঔষধ প্রয়োগে এবং কর্ডেলিয়ার সেবাযত্নে লিয়ার ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। কিন্তু রাজা লিয়ারের ভাগ্য নিতান্তই খারাপ। তাঁর দুঃখ ও অপমানের দিন এখনো যেন শেষ হয়নি।

গনেরিল ও রিগানের প্রেরিত সম্মিলিত সেনাবাহিনীর কাছে কর্ডেলিয়ার অপ্রতুল সেনাবাহিনী পরাজিত হয় এবং রাজা লিয়ার কর্ডেলিয়াসহ বন্দি হলেন। এডমন্ড কৌশলে গুপ্তঘাতককে নির্দেশ দিয়ে কর্ডেলিয়ার প্রাণসংহার করাল। রাজা লিয়ারের শেষ অবলম্বনটুকুও এভাবে নিঃশেষ হয়ে গেল। তাঁর বুকফাটা হাহাকারে এই অকরুণ পৃথিবীর নির্মম আকাশও যেন ফেটে চৌচির হয়ে গেল।

(সংক্ষেপিত)

common.content_added_by

লেখক-পরিচিতি

36
36

ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবশালী কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়র। তাঁর জন্ম ইংল্যান্ডের স্ট্রাটফোর্ড-অব-অ্যাভনে, ১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে। শেক্সপিয়রের জীবন ছিল দুঃখ-দুর্দশায় ভরা। মাত্র বায়ান্ন বছরের জীবনের মধ্যে তাঁর সাহিত্য রচনার কাল ছিল তিরিশ বছরেরও কম। তিনি কমেডি ও ট্র্যাজেডিধর্মী নাটক রচনা করলেও পৃথিবীর সেরা ট্র্যাজেডি-লেখক হিসেবেই সম্মান পান। শেক্সপিয়রের সেরা ট্র্যাজেডিগুলো হচ্ছে 'হ্যামলেট', 'ম্যাকবেথ', 'ওথেলো' ও 'কিং লিয়ার'। উল্লেখযোগ্য কমেডিগুলো হচ্ছে 'কমেডি অব এররূস', 'অ্যাজ ইউ লাইক ইট', 'আ মিডসামার নাইটস ড্রিমস' ইত্যাদি। এসব নাটকে তিনি আনন্দ-বেদনার অন্তরালে মানুষের জীবনের গভীর সত্যকে সন্ধান করেছেন। শেক্সপিয়র মৃত্যুবরণ করেন ১৬১৬ খ্রিষ্টাব্দে।

common.content_added_by

রূপান্তরকারী লেখক-পরিচিতি

52
52

জাহানারা ইমামের জন্ম ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায়। পেশায় তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক, ছিলেন নিবেদিত সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠক। জাহানারা ইমাম একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন। সাহিত্যজীবনে শিশুসাহিত্য, অনুবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, স্মৃতিকথা প্রভৃতি বিচিত্র ধরনের রচনায় সৃষ্টিমুখর ছিলেন। 'একাত্তরের দিনগুলি' তাঁর সর্বাধিক পরিচিত ও জনপ্রিয় গ্রন্থ। তাঁর উল্লেখযোগ্য অপর গ্রন্থগুলো হচ্ছে 'ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস', 'শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডি', 'নিঃসঙ্গ পাইন'। 'গজকচ্ছপ', 'সাতটি তারার ঝিকিমিকি' ইত্যাদি তাঁর শিশুতোষ রচনা। একাত্তরে জাহানারা ইমামের জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযোদ্ধা সফি ইমাম রুমী শহিদ হওয়ার কারণে তিনি 'শহিদ-জননী' হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও স্বাধীনতা পদকও লাভকরেন। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।

common.content_added_by

পাঠ-পরিচিতি ও মূলভাব

41
41

রচনাটি উইলিয়াম শেক্সপিয়রের 'কিং লিয়ার' নাটকের সংক্ষিপ্ত আখ্যান বা গল্পরূপ। ব্রিটেনের রাজা লিয়ার বৃদ্ধকালে স্থির করলেন তাঁর তিন মেয়ে গনেরিল, রিগান আর কর্ডেলিয়াকে রাজ্য ভাগ করে দেবেন। রাজসভা ডেকে সভাসদদের সামনেই তিন মেয়েকে একে একে জিজ্ঞেস করলেন কে তাঁকে কতটুকু ভালোবাসে। বড়ো দুই মেয়ে গনেরিল আর রিগান বলে দিল তারা তাদের প্রাণের চেয়েও বেশি বাবাকে ভালোবাসে সুতরাং তিনি তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সমানভাগে ভাগ করে দিলেন। ছোটো মেয়ে কর্ডেলিয়াকে রাজা ভালোবাসতেন বেশি, তাই তার কাছে প্রত্যাশাও ছিল বেশি। কিন্তু এই কন্যার কাছে যা শুনলেন তাতে, রাজা গেলেন খেপে। কর্ডেলিয়া বলল, একটি মেয়ের তার বাবাকে যতটা ভালোবাসা কর্তব্য ততটাই সে ভালোবাসে। রাজা লিয়ার কর্ডেলিয়াকে ত্যাজ্য করলেন, তাকে রাজ্য থেকে বের করে দিলেন এবং সম্পূর্ণ রাজ্য বড়ো ও মেজো মেয়ের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। রাজা লিয়ারের এমন অবিচক্ষণ সিদ্ধান্ত তার জীবনের জন্য কাল হলো। সমুদয় রাজ্য দুই মেয়েকে দান করায় তিনি তাদের করুণার পাত্র হয়ে পড়লেন; একসময় দুবোন মিলে রাজাকে রাজবাড়ি থেকে বের করে দিল। রাজার জীবনে নেমে এল দুঃসহ গ্লানি আর দুঃখ। তিনি বুঝতে পারলেন, গনেরিল আর রিগানের ভালোবাসা ছিল মেকি আর কর্ডেলিয়ার ভালোবাসা ছিল সত্যিকারের। কিন্তু তাঁর করার কিছুই ছিল না। একপর্যায়ে তিনি প্রায় উন্মাদ হয়ে যান। লিয়ারের এই দুঃসময়ে তাঁর কাছে এসে দাঁড়ায় ত্যাজ্য ছোটো মেয়ে কর্ডেলিয়াই। মানুষ তার নিজের ভুলের জন্য দুঃখ, কষ্ট আর বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। কিং লিয়ার তোষামোদে তুষ্ট হয়ে জীবনে করুণ পরিণতি ডেকে এনেছেন। ভুলে গিয়েছিলেন প্রকৃত ভালোবাসা অনুভূতির ব্যাপার, তা পরিমাপযোগ্য বিষয় নয়।

common.content_added_by

শব্দার্থ ও টীকা

42
42

ডিউক - ইংল্যান্ডে প্রচলিত একটি সম্মানজনক উপাধি। ইংরেজি Duke.
পাণিপ্রার্থী - বিয়ে করতে ইচ্ছুক।
আর্ল - একটি উপাধি। ইংল্যান্ডে প্রচলিত ছিল।
জ্যোতি - আলো, উজ্জ্বল।
সন্তোষ - আনন্দ, খুশি।
এক-তৃতীয়াংশ - তিন ভাগের এক ভাগ।
হৃষ্টচিত্তে - আনন্দচিত্তে, খোশমেজাজে।
স্তম্ভিত - কোনো কারণে জড়ের মতো হয়ে যাওয়া। নির্বাক।
ক্রোধ - রাগ।
পালাক্রমে - একে একে।
আনন্দোৎসব - আনন্দ উদ্যাপনের জন্য যে উৎসব।
অন্তঃসারশূন্য - যার ভেতরে কিছু নেই। -
তোষামোদ - চাটুকারিতা।
ক্ষিপ্ত - ক্ষুব্ধ, রাগান্বিত।
কপর্দকশূন্য - টাকা-পয়সা নেই, এমন বোঝানো হয়েছে।
অশ্রুপূর্ণ - জলে ভরা।
প্রভেদ - পার্থক্য।
অনুচর - সঙ্গী, সহচর, ভৃত্য।
যোদ্ধারক্ষী - পাহারাদার সেনা।
উৎপাত - যন্ত্রণা, উপদ্রব।
তড়িঘড়ি – তাড়াতাড়ি।
রক্ষী - পাহারাদার, সেনা।
উপলব্ধি - অনুভব, অনুভূতি, বোধ।
নিদারুণ - কঠিন, নির্দয়।
বিদূষক - ভাঁড়, যে কৌতুক করে। রঙ্গরস-সৃষ্টিকারী অনুচর।
খামখেয়ালি - খেয়ালখুশি, খুশিমতো চলার স্বভাব বিশিষ্ট।

common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion