মানুষ ভাষা-সম্পদের অধিকারী। ভাব প্রকাশের প্রয়োজন থেকেই ভাষার উদ্ভব। মানুষের উচ্চারিত অর্থবহ বহুজনবোধ্য ধ্বনিসমষ্টিই ভাষা। পরস্পর ভাব-বিনিময়ের জন্য এক-এক সমাজের মানুষ গড়ে তুলেছে এক-এক রকম ধ্বনিব্যবস্থা। ভাষা হচ্ছে অর্থবহ প্রণালিবদ্ধ ধ্বনি-প্রতীক। মানুষ তার কণ্ঠনিঃসৃত যে ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টির মাধ্যমে ভাব ও অনুভূতিকে অন্যের কাছে বোধগম্যভাবে পৌঁছে দেয়, তা-ই ভাষা (Language)। ভাষা মানবগোষ্ঠীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সম্পদ। সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক ভাব বিনিময়ে ভাষা একটি উন্নত মাধ্যম।
মানবসভ্যতার বিকাশে ভাষার ভূমিকা অপরিসীম। আদিমকালে মানুষ যখন গুহাবাসী, বন্য ও অভব্য ছিল, তখনো মানুষ নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান করত। তখন ভাব-বিনিময়ের মাধ্যম ছিল ইশারা-ইঙ্গিত-অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি। এগুলো ভাষা বিকাশের প্রাথমিক রূপ হিসেবে বিবেচ্য। বস্তুত আদিকালে মানুষ পারস্পরিক ভাব-বিনিময়ের জন্য যেসব মাধ্যম ব্যবহার করত সেগুলো হলো:
(ক) ইশারা-ইঙ্গিত, (খ) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার, (গ) নাচ, (ঘ) চিত্র ইত্যাদি।
সৃষ্টির প্রথম যুগে সভ্যতার সোপানে প্রথম পদক্ষেপ হলো সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করা। আর এ থেকেই তৈরি হলো সমাজ। কালের যাত্রায় মানুষ যখন সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করতে শুরু করল, তখন সে বুঝতে পারল যে কেবল ইশারা-ইঙ্গিত, অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা যায় না। নিরন্তর প্রচেষ্টা, বুদ্ধি ও সাধনার মাধ্যমে কালক্রমে মানুষ ধ্বনির প্রণালিবদ্ধ উচ্চারণ ও ব্যবহারে সক্ষম হলো।
মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত বাধ্বনিই ভাষা হিসেবে গৃহীত। বলা বাহুল্য, ইঙ্গিতের মাধ্যমেও ভাবের আদান-প্রদান করা যায়, কিন্তু কণ্ঠধ্বনি হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের সর্বোত্তম প্রক্রিয়া। কণ্ঠধ্বনির মাধ্যমে মানুষ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাব প্রকাশে সক্ষম। তাই আমরা ভাষা বলতে বুঝি বাগ্যন্ত্র-সৃষ্ট সর্বজনবোধ্য ধ্বনিসমষ্টিকে। অর্থাৎ মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য কণ্ঠ, জিহ্বা, ওষ্ঠ, দন্ত, নাসিকা, মুখবিবর প্রভৃতি বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে বোধগম্য যে ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি উচ্চারণ করে থাকে, সেই ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিই ভাষা।
সংজ্ঞার্থ: মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য মনুষ্যজাতি অপরের বোধগম্য যে ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি উচ্চারণ করে থাকে, তাকে ভাষা বলে।
ভাষাবিজ্ঞানীগণ বিভিন্নভাবে ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এ প্রসঙ্গে কয়েকজন প্রখ্যাত ভাষাপণ্ডিতের ভাষা-সম্পর্কিত চিন্তাসূত্র উদ্ধৃত করা হলো:
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে, 'মনুষ্যজাতি যে ধ্বনি বা ধ্বনিসকল দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করে, তার নাম ভাষা।'
ভাষা সম্পর্কে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, 'মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত, ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন, কোনো বিশেষ সমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত, তথা বাক্যে প্রযুক্ত শব্দ-সমষ্টিকে ভাষা বলে।'
মূলত মানুষের মনোভাব-প্রকাশক কণ্ঠনিঃসৃত অর্থবহ ধ্বনিসমষ্টিই ভাষা।
১. ভাষা কণ্ঠনিঃসৃত ধ্বনির সাহায্যে গঠিত;
২. ভাষার অর্থদ্যোতকতা গুণ বিদ্যমান;
৩. ভাষা একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত ও ব্যবহৃত;
৪. ভাষা মানুষের স্বেচ্ছাকৃত আচরণ ও অভ্যাসের সমষ্টি;
দেশ, কাল ও পরিবেশভেদে ভাষার পার্থক্য ও পরিবর্তন ঘটে। আদি মানবের যে ভাষা ছিল, কালের প্রবাহে তা পরিবর্তিত হয়ে বহু ভাষার জন্ম দিয়েছে। এ জন্য আমরা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার দেখতে পাই। যেমন: বাংলাদেশে 'বাংলা ভাষা', ইংল্যান্ডে 'ইংরেজি ভাষা', জাপানে 'জাপানি ভাষা', রাশিয়ায় 'বুশ ভাষা' ইত্যাদি। বর্তমানে পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজারের ওপর ভাষা প্রচলিত আছে।
বাংলা ভাষা হাজার বছরের পুরনো। বাংলা ভাষার উৎসমূলে যে ভাষার সন্ধান পাওয়া যায়, তার নাম ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষা। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে ইউরোপের মধ্যভাগ হতে দক্ষিণ-পূর্বাংশ ভূভাগে ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষা প্রচলিত ছিল। এ ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষাই হলো বাংলা ভাষার আদি উৎস। তবে এ আদি উৎস থেকে বিবর্তনের পরবর্তী ধাপেই বাংলা ভাষার জন্ম হয়নি। ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তন ও বিবর্তনের ধারায় অনেক কাল ধরে অনেকগুলো স্তর পেরিয়ে সপ্তম শতকে বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছে। তবে বাংলা ভাষার উদ্ভবকাল নির্ণয়ে পণ্ডিতগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে, বাংলা ভাষার উদ্ভবকাল ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ। আর ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ৯৫০ খ্রিষ্টাব্দকে বাংলা ভাষার উদ্ভবকাল বলে মনে করেন।
বাংলাদেশের মানুষ তাদের মনের ভাব প্রকাশের জন্য যে ভাষা ব্যবহার করে, তার নাম বাংলা ভাষা। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খণ্ড, বিহার, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা, আসামের করিমগঞ্জ ও কাছাড়ের অধিবাসীদের একটি অংশের মাতৃভাষা বাংলা। বস্তুত, দেশ-জাতি-ধর্মনির্বিশেষে বাঙালি জনসমাজে ব্যবহৃত শব্দ নিয়ে বাংলা ভাষা গঠিত। বাংলা ভাষা প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারের ফলে বাংলা ভাষায় বিভিন্ন রূপের সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, পৃথিবীর সব ভাষাতেই দুটো রূপ দেখা যায়। একটি লেখার ভাষা, অন্যটি মুখের ভাষা। ভাষারীতির দিক থেকে বাংলা ভাষার দুটি রূপ বা রীতি লক্ষ করা যায়। একটি সাধু ভাষা এবং অপরটি চলিত ভাষা।
সাধু ভাষা বাংলা ভাষার একটি প্রাচীন লিখিত রূপ। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগে পদ্যই ছিল ভাব প্রকাশের প্রধান বাহন। মধ্যযুগে কতিপয় ক্ষেত্রে চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজে গদ্যের ব্যবহার দেখা গেলেও তা ছিল খুবই সীমিত। ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বাংলা গদ্যে গ্রন্থ প্রণয়নের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে কেন্দ্র করে গদ্যচর্চা শুরু হয়। সেদিনকার গদ্য লেখকগণ গদ্যগ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে মূলত নির্ভর করলেন সাধুজনের মধ্যে ব্যবহৃত সংস্কৃত ভাষার ওপর। এভাবে উনিশ শতকে বাংলা গদ্যের যে লিখিত রূপ গড়ে ওঠে, তার নাম দেওয়া হয় সাধু ভাষা। সাধু ভাষা সম্পর্কে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, 'সাধু ভাষা সমগ্র বঙ্গদেশের সম্পত্তি। এর চর্চা সর্বত্র প্রচলিত থাকাতে বাঙালির পক্ষে ইহাতে লেখা সহজ হইয়াছে।'
বস্তুত বাংলা গদ্যের প্রাথমিক পর্যায়ে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ পণ্ডিত সংস্কৃত ভাষার অনুসরণে তৎসম শব্দবহুল যে সাহিত্যিক গদ্যরীতি গড়ে তোলেন, তা-ই সাধু ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।
কোনো একটি প্রধান ভাষার আওতাভুক্ত সমগ্র ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন কথ্যরূপ বা মৌখিক ভাষা ব্যবহৃত হয়। মুখের ভাষাকে লিখিত ভাষায় ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে চলিত ভাষার প্রচলন হয়। তবে সবার মুখের ভাষাই চলিত ভাষা নয়, কারণ মুখের ভাষা অঞ্চলভেদে পরিবর্তন হয়। তাই নির্দিষ্ট অঞ্চলে একটি নির্দিষ্ট এলাকার শিক্ষিত ও শিষ্টজনের মৌখিক ভাষাকে মান চলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী এলাকা এবং কলকাতার ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষাটিকে অল্প-বিস্তর পরিমার্জিত করে একটি সর্বজনবোধ্য আদর্শ কথ্য ভাষা গড়ে তোলা হয়। এটাই হলো বাংলার আদর্শ চলিত ভাষা। বাংলা ভাষাভাষী শিক্ষিত জনগণ এ আদর্শ ভাষাতেই পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদান করে থাকে। চলিত ভাষা বর্তমানে একাধারে লেখার ভাষা ও মুখের ভাষা।
মূলত যে ভাষারীতিতে ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদ সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যবহৃত হয়, তাকে চলিত ভাষা বলে। যেমন : তারা খেলছে। ওরা ঘুমিয়ে রয়েছে।
প্রধানত ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদের পার্থক্য বিবেচনা করেই সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা নিরূপণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় 'তাহারা পড়িতেছে'- বাক্যটিতে দুটি পদ আছে। 'তাহারা' সর্বনাম পদ এবং 'পড়িতেছে' ক্রিয়াপদ। সাধু ভাষার উল্লিখিত পদ দুটোতে সর্বনাম পদ ও ক্রিয়াপদ পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। এবার বাক্যটিকে চলিত ভাষায় রূপান্তর করলে তার রূপ দাঁড়াবে 'তারা পড়ছে'। এ ক্ষেত্রে বাক্যটিতে 'তারা' সর্বনাম পদ এবং 'পড়ছে' ক্রিয়াপদ সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যবহৃত হয়েছে।
সাধু ভাষার ক্রিয়াপদ : করিতেছি, খাইয়াছি, বলিতেছি, যাইতেছি, পড়িতেছি, দেখিতেছি ইত্যাদি।
চলিত ভাষার ক্রিয়াপদ : করছি, খেয়েছি, বলছি, যাচ্ছি, পড়ছি, দেখছি ইত্যাদি।
সাধু ভাষার সর্বনাম পদ : তাহার, তাহারা, তাহাদের, উহাদের ইত্যাদি।
চলিত ভাষার সর্বনাম পদ : তার, তারা, তাদের, ওদের ইত্যাদি।
সাধু ভাষা ও চলিত ভাষায় ক্রিয়াপদের কতিপয় রূপ:
সাধু ভাষা | চলিত ভাষা |
করিব | করব |
পড়িব | পড়ব |
লিখিব | লিখব |
করিতেছিলাম | করছিলাম |
পড়িতেছিলাম | পড়ছিলাম |
লিখিয়াছি | লিখেছি |
করিয়াছি | করেছি |
পড়িয়াছি | পড়েছি |
পড়িতে থাকিব | পড়তে থাকব |
করিতেছি | করছি |
করিলাম | করলাম |
খাইতেছে | খাচ্ছে |
হইত | হতো |
খাইবে | খাবে |
যাইবে | যাবে |
বলিব | বলব |
করিলে | করলে |
যাইও | যেয়ো/যেও |
খাইও | খেয়ো/খেও |
লইব | নেব |
করিতাম | করতাম |
হইয়া | হয়ে |
সাধু ভাষা ও চলিত ভাষায় সর্বনাম পদের কতিপয় রূপ:
সাধু ভাষা | চলিত ভাষা |
তাহার | তার |
তাহাদের | তাদের |
তাহাতে | তাতে |
তাহারা | তারা |
তাহাকে | তাকে |
ইহারা | এরা |
ইহাদের | এদের |
উহারা | ওরা |
উহাদের | ওদের |
উহা | ও |
এই | এ |
ইহা | এটি |
ইহাকে | একে |
কাহার | কার |
যাহা | যা |
যাহারা | যারা |
ইহার | এর |
কাহাকে | কাকে |
যাহাকে | যাকে |
সাধু ভাষা ও চলিত ভাষার বৈশিষ্ট্য
সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা নানা দিক থেকে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। এ উভয় ভাষারীতির বৈশিষ্ট্য পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো:
১. সাধু ভাষায় ক্রিয়াপদের রূপ পূর্ণাঙ্গ। যেমন: করিয়াছি, গিয়াছি।
২. সাধু ভাষায় সর্বনাম পদের রূপ পূর্ণাঙ্গ। যেমন তাহার, তাহারা, তাহাদের।
৩. সাধু ভাষায় অনুসর্গের পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন: হইতে, দিয়া।
৪. সাধু ভাষায় তৎসম শব্দের (সংস্কৃত শব্দ) প্রয়োগ বেশি। যেমন: হস্ত, মস্তক, ঘৃত, ধৌত।
৫. সাধু ভাষার উচ্চারণ গুরুগম্ভীর।
৬. সাধু ভাষা সুনির্ধারিত ব্যাকরণের অনুসারী। এর কাঠামো সাধারণত অপরিবর্তনীয়।
৭. সাধু ভাষা বক্তৃতা ও নাট্য সংলাপের অনুপযোগী।
১. চলিত ভাষায় ক্রিয়াপদের রূপ সংক্ষিপ্ত। যেমন: করেছি, গিয়েছি।
২. চলিত ভাষায় সর্বনাম পদের রূপ সংক্ষিপ্ত। যেমন তারা, তাদের।
৩. চলিত ভাষায় অনুসর্গের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন হতে, দিয়ে।
৪. চলিত ভাষায় তদ্ভব, অর্ধ-তৎসম, দেশি ও বিদেশি শব্দের ব্যবহার বেশি। যেমন: হাত, মাথা, ঘি, ধোয়া।
৫. চলিত ভাষার উচ্চারণ হালকা ও গতিশীল।
৬. চলিত ভাষা পরিবর্তনশীল।
৭. চলিত ভাষা চটুল, জীবন্ত ও লোকায়ত।
সাধু ও চলিত ভাষার বৈশিষ্ট্য থেকে এ ভাষারীতির পার্থক্য সহজেই অনুধাবন করা যায়। নিচে সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য উল্লেখ করা হলো:
সাধু ভাষা | চলিত ভাষা |
সাধু ভাষায় ক্রিয়াপদের রূপ পূর্ণাঙ্গ। যেমন করিয়াছি, গিয়াছি। | চলিত ভাষায় ক্রিয়াপদের রূপ সংক্ষিপ্ত। যেমন: করেছি, গিয়েছি। |
সাধু ভাষায় সর্বনাম পদের রূপ পূর্ণাঙ্গ। যেমন: তাহার, তাহারা, তাহাদের। | চলিত ভাষায় সর্বনাম পদের রূপ সংক্ষিপ্ত। যেমন : তার, তারা, তাদের। |
সাধু ভাষায় তৎসম শব্দের (সংস্কৃত শব্দ) প্রয়োগ বেশি। যেমন: হস্ত, মস্তক, ঘৃত, ধৌত। | চলিত ভাষায় তদ্ভব, অর্ধ-তৎসম, দেশি ও বিদেশি শব্দের ব্যবহার বেশি। যেমন: হাত, মাথা, ঘি, ধোয়া। |
সাধু ভাষায় অনুসর্গের পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন: হইতে, দিয়া। | চলিত ভাষায় অনুসর্গের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন: হতে, দিয়ে। |
সাধু ভাষা বক্তৃতা ও নাট্য সংলাপের অনুপযোগী। | চলিত ভাষা বক্তৃতা ও নাট্য সংলাপের উপযোগী। |
সাধু ভাষা মার্জিত। | চলিত ভাষা চটুল, জীবন্ত ও লোকায়ত। |
সাধু ভাষার নমুনা
১. বালকগণের উচিত, বাল্যকাল অবধি পরিশ্রম করিতে অভ্যাস করা, তাহা হইলে বড় হইয়া অনায়াসে সকল কর্ম করিতে পারিবে, স্বয়ং অন্ন-বস্ত্রের ক্লেশ পাইবে না এবং বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতিপালন করিতেও পারগ হইবে।
[ বোধোদয়: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
২. যাহা জ্ঞানের কথা তাহা প্রচার হইয়া গেলেই তাহার উদ্দেশ্য সফল হইয়া শেষ হইয়া যায়। মানুষের জ্ঞান সম্বন্ধে নূতন আবিষ্কারের দ্বারা পুরাতন আবিষ্কার আচ্ছন্ন হইয়া যাইতেছে। কাল যাহা পণ্ডিতের
অগম্য ছিল আজ তাহা অর্বাচীন বালকের কাছেও নূতন নহে। [সাহিত্যের সামগ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
চলিত ভাষার নমুনা
১. আমাদের মনে হয় এ দেশে লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু কম নয় এবং স্কুল-কলেজের চাইতে একটু বেশি। এ কথা শুনে অনেকে চমকে উঠবেন। কেউ কেউ আবার হেসেও উঠবেন; কিন্তু আমি জানি, আমি রসিকতাও করছিনে; যদিও এ বিষয়ে লোকমত যে আমার মতের সমরেখায় চলে না, সে বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ সচেতন।
[বই পড়া: প্রমথ চৌধুরী।
২. বৃক্ষের দিকে তাকালে জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি সহজ হয়। তাই, বারবার সেদিকে তাকানো প্রয়োজন। মাটির রস টেনে নিয়ে নিজেকে মোটাসোটা করে তোলাতেই বৃক্ষের কাজের সমাপ্তি নয়। তাকে ফুল ফোটাতে হয়, ফল ধরাতে হয়। নইলে তার জীবন অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে। তাই বৃক্ষকে সার্থকতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা সজীবতা ও সার্থকতার এমন দৃষ্টান্ত আর নেই।
[জীবন ও বৃক্ষ: মোতাহের হোসেন চৌধুরী।
ভাষারীতির পরিবর্তন
(ক) সাধু থেকে চলিত
সাধুরীতি | চলিতরীতি |
পথে এক যুবকের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইল। | পথে এক যুবকের সঙ্গে তার দেখা হলো। |
গফুর চুপ করিয়া রহিল। | গফুর চুপ করে রইল। |
পাকা দুই ক্রোশ পথ হাঁটিয়া স্কুলে বিদ্যা অর্জন করিতে যাই। | পাকা দুক্রোশ পথ হেঁটে স্কুলে বিদ্যা অর্জন করতে যাই। |
আমি ব্যাপারটি বুঝিয়া আমার বিছানা গুটাইয়া লইয়া তাহাদের স্থান করিয়া দিলাম। | আমি ব্যাপারটা বুঝে আমার বিছানা গুটিয়ে নিয়ে তাদের জায়গা করে দিলাম। |
আমিনা ঘর হইতে দুয়ারে আসিয়া দাঁড়াইল। | আমিনা ঘর হতে দুয়ারে এসে দাঁড়াল। |
(খ) চলিত থেকে সাধু
চলিতরীতি | সাধুরীতি |
চেয়ে দেখি, আমাদের রহমতকে দু পাহারাওয়ালা বেঁধে নিয়ে আসছে। | চাহিয়া দেখি, আমাদের রহমতকে দুই পাহারাওয়ালা বাঁধিয়া লইয়া আসিতেছে। |
হাজার বছর ধরে মানুষ এদের দেখছে। | হাজার বছর ধরিয়া মানুষ ইহাদের দেখিতেছে। |
পাশেই কিছু দূরে একটা শালুক দেখতে পায় ওসমান। | পার্শ্বেই কিছু দূরে একটি শালুক দেখিতে পায় ওসমান। |
আমাদের এ ভীরুতা কি চিরদিনই থেকে যাবে? | আমাদের এই ভীরুতা কি চিরদিনই থাকিয়া যাইবে? |
এ কথা শুনে অনেকে চমকে উঠবেন। | এই কথা শুনিয়া অনেকে চমকিয়া উঠিবেন। |
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন: (নমুনা)
১। বাংলা ভাষার উৎসমূল কোন ভাষা?
ক. আর্য ভাষা
খ. সংস্কৃত মূল ভাষা
গ. ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষা
ঘ. গৌড়ীয় বঙ্গ ভাষা
২ । নিচের কোন বাক্যটি সাধু ভাষার উদাহরণ?
ক. আমি আজ বাড়ি যাব।
খ. আমি আজ সুস্থবোধ করিতেছি।
গ. আমি আজ বই মেলায় যাব।
ঘ. তাকে আমার খুব প্রয়োজন।
৩। চলতি ভাষার বৈশিষ্ট্য হলো-
i. ক্রিয়া পদের রূপ সংক্ষিপ্ত হয়।
ii. সর্বনাম পদের রূপ সংক্ষিপ্ত হয়।
iii. উচ্চারণ খুবই গুরুগম্ভীর।
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. ii ও iii
১। ভাব প্রকাশ, অর্থবহতা, বাগ্-যন্ত্র-এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে ভাষার একটি সংজ্ঞা তৈরি কর।
|
৪। প্রদত্ত শব্দগুলোর পরিবর্তিত রূপ ডান পাশের সঠিক ঘরে বসাও কাহাকে, যার, উহাদের, করিলাম, চেনা, গ্রাম্য, পূজা, বরং, তথাপি, হচ্ছে।
প্রদত্ত শব্দ | সাধু | চলিত |
|
|
|
common.read_more