ধ্বনি ও বর্ণ

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি - | NCTB BOOK
172
172

ধ্বনি

ভাষার ক্ষুদ্রতম একক ধ্বনি। কোনো ভাষার উচ্চারিত শব্দকে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে তার যে অবিভাজ্য ক্ষুদ্রতম অংশ পাওয়া যায়, তা-ই ধ্বনি। মানুষের বাগ্যন্ত্রের সহায়তায় উচ্চারিত ধ্বনি থেকেই ভাষার সৃষ্টি। বস্তুত ভাষাকে বিশ্লেষণ করলে চারটি মৌলিক উপাদান পাওয়া যায়। এই উপাদানগুলো হলো-ধ্বনি, শব্দ, বাক্য ও অর্থ। মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য 'কথা' বলে। মানুষের 'কথা' হলো অর্থযুক্ত কিছু ধ্বনি। ব্যাকরণ শাস্ত্রে মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত শব্দ বা আওয়াজকেই ধ্বনি বলা হয়। বস্তুত অর্থবোধক ধ্বনিসমূহই মানুষের বিভিন্ন ভাষার বাধ্বনি। ধ্বনিই ভাষার মূল ভিত্তি।

ধ্বনি নির্গত হয় মুখ দিয়ে। ধ্বনি উৎপাদনে মুখ, নাসিকা, কণ্ঠ প্রভৃতি বাক্-প্রত্যঙ্গ ব্যবহৃত হলেও ধ্বনি উৎপাদনের মূল উৎস হলো ফুসফুস। ফুসফুসের সাহায্যে আমরা শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করি। ফুসফুস থেকে বাতাস বেরিয়ে আসার সময় বিভিন্ন বাক্-প্রত্যঙ্গের সংস্পর্শে আসে। ফুসফুস থেকে বাতাস স্বরযন্ত্রের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় মুখের বিভিন্ন জায়গায় ঘষা খায়। এই ঘর্ষণের ফলে মুখে নানা ধরনের ধ্বনির সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ ফুসফুস নির্গত বাতাস স্বরযন্ত্রের মধ্য দিয়ে মুখগহ্বরে প্রবেশের পর বিভিন্ন বাক্-প্রত্যঙ্গের সংস্পর্শে আঘাত লাগার দরুন ধ্বনি গঠিত বা তৈরি হয়। ধ্বনি গঠনে বিভিন্ন বাক্- প্রত্যঙ্গের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ধ্বনির শ্রেণিবিভাগ

'ধ্বনি'র সাধারণ অর্থ যেকোনো ধরনের 'আওয়াজ'। কিন্তু ব্যাকরণে মানুষের বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি আওয়াজকে ধ্বনি বলে। ধ্বনি দুই প্রকার। যেমন: ক. স্বরধ্বনি ও খ. ব্যঞ্জনধ্বনি

বর্ণ

কোনো ভাষার ধ্বনিগুলোকে লিখে প্রকাশ করার জন্য যে প্রতীক বা চিহ্ন ব্যবহৃত হয়, তাকে বর্ণ বলে। অ, আ, ক, খ প্রভৃতি বাংলা ভাষার একেকটি ধ্বনি-প্রতীক বা বর্ণ।

বর্ণমালা

কোনো ভাষার বর্ণসমষ্টির সুনির্দিষ্ট সাজানো ক্রমকে বর্ণমালা বলে। ধ্বনি যেমন দুই প্রকার-স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি; তেমনি এদের লিখিত প্রতীকও দুই প্রকার। যথা: স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ।

স্বরধ্বনি ও স্বরবর্ণ

যেসব ধ্বনি অন্য ধ্বনির সাহায্য ছাড়া নিজে নিজে পূর্ণ ও স্পষ্টরূপে উচ্চারিত হয়, তাকে স্বরধ্বনি বলে। আর এই স্বরধ্বনির প্রতীক বা লিখিত রূপই হচ্ছে স্বরবর্ণ। যেমন: অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ। স্বববর্ণের সংখ্যা মোট ১১টি।

ব্যঞ্জনধ্বনি ও ব্যঞ্জনবর্ণ

যেসব ধ্বনি স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়া নিজে নিজে পূর্ণ বা স্পষ্টরূপে উচ্চারিত হতে পারে না, তাকে ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। আর এই ব্যঞ্জনধ্বনির লিখিত রূপই হচ্ছে ব্যঞ্জনবর্ণ। যেমন: ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, জ, ঝ, ঞ, ট, ঠ, ড, ঢ, ণ, ত, থ, দ, ধ, ন, প, ফ, ব, ভ, ম, য, র, ল, শ, ষ, স, হ, ড়, ঢ়, য়, ৎ, ং, ঃ, ঁ। ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা মোট ৩৯টি।

স্বরধ্বনির উচ্চারণ স্থান ও বৈশিষ্ট্য
ধ্বনি/বর্ণউচ্চারণ স্থানউচ্চারণ স্থান অনুসারে নাম
অ, আকণ্ঠকণ্ঠ্যধ্বনি
ই, ঈতালুতালব্যধ্বনি
উ, উঠোঁট বা ওষ্ঠওষ্ঠ্যধ্বনি
মূর্ধামূর্ধন্যধ্বনি
এ, ঐকণ্ঠ ও তালুকণ্ঠ্যতালব্যধ্বনি
ও, ঔকণ্ঠ ও ওষ্ঠকণ্ঠৌষ্ঠ্যধ্বনি

উচ্চারণস্থান অনুসারে ব্যঞ্জনধ্বনির পাঁচটি বিভাগ রয়েছে। এই বিভাগগুলোকে বর্গ বলে। প্রথম ধ্বনির নাম অনুসারে বর্গের নাম নির্দেশ করা হয়। যেমন:

ক বর্গক খ গ ঘ ঙ
চ বর্গচ ছ জ ঝ ঞ
ট বর্গট ঠ ড ঢ ণ
ত বর্গত থ দ ধ ন
প বর্গপ ফ ব ভ ম

ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণস্থান ও বৈশিষ্ট্য

ধ্বনি/বর্ণউচ্চারণ স্থানউচ্চারণ স্থান অনুসারে নাম
ক, খ, গ, ঘ, ঙকণ্ঠ বা জিহ্বামূলকণ্ঠ্য বা জিহ্বামূলীয় ধ্বনি
চ, ছ, জ, ঝ, শতালুতালব্যধ্বনি
ট, ঠ, ড, ঢ, ড়, ঢ়মূর্ধামূর্ধন্যধ্বনি
ত, থ, দ, ধদাঁত বা দন্তদন্ত্যধ্বনি
প, ফ, ব, ভ, মঠোঁট বা ওষ্ঠওষ্ঠ্যধ্বনি
কণ্ঠ্যধ্বনি

যেসব ধ্বনির উচ্চারণস্থান কণ্ঠনালির উপরিভাগ বা জিহ্বামূল, তাদের কণ্ঠ্যধ্বনি বলে। যেমন: অ, আ, ক, খ, গ, ঘ, ঙ, হ কণ্ঠ্যধ্বনির উদাহরণ।

তালব্যধ্বনি

যেসব ধ্বনির উচ্চারণস্থান তালু, তাদের তালব্যধ্বনি বলে। যেমন: চ, ছ, জ, ঝ, শ তালব্যধ্বনির উদাহরণ।

মূর্ধন্যধ্বনি

যেসব ধ্বনির উচ্চারণস্থান মূর্ধা বা তালুর অগ্রভাগ, তাদের মূর্ধন্যধ্বনি বলে। যেমন: ট, ঠ, ড, ঢ, ড়, ঢ়, মূর্ধন্যধ্বনির উদাহরণ।

দন্ত্যধ্বনি

যেসব ধ্বনির উচ্চারণস্থান দন্তমূল, তাদের দন্ত্যধ্বনি বলে। ত, থ, দ, ধ দন্ত্যধ্বনির উদাহরণ।

ওষ্ঠ্যধ্বনি

যেসব ধ্বনির উচ্চারণস্থান ওষ্ঠ, তাদের ওষ্ঠ্যধ্বনি বলে। উ, ঊ, প, ফ, ব, ভ, ম ওষ্ঠ্যধ্বনি।

নাসিক্য বা অনুনাসিকধ্বনি

ঙ, ঞ, ণ, ন, ম-এগুলোর উচ্চারণকালে মুখবিবরের বাতাস নাক দিয়ে বের হয় বলে এগুলোকে নাসিক্য বা অনুনাসিকধ্বনি বলে।

অঘোষধ্বনি

প্রত্যেক বর্গের প্রথম দুটি ধ্বনি এবং শ, স এগুলোর উচ্চারণকালে আঘাতজনিত ঘোষ বা শব্দ সৃষ্টি হয় না বলে, এগুলোকে অঘোষধ্বনি বলে। এদেরকে শ্বাসধ্বনিও বলা হয়।

ঘোষধ্বনি

বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম ধ্বনি এবং হ এগুলোর উচ্চারণকালে আঘাতজনিত ঘোষ বা শব্দ সৃষ্টি হয় বলে, এগুলোকে ঘোষধ্বনি বলে। ঘোষধ্বনিকে নাদধ্বনিও বলা হয়।

অল্পপ্রাণ ধ্বনি

প্রত্যেক বর্গের প্রথম, তৃতীয় ও পঞ্চম ধ্বনির উচ্চারণকালে বাতাসের চাপের স্বল্পতা থাকে বলে এদের অল্পপ্রাণ ধ্বনি বলে। যেমন ক, গ, ঙ, চ, জ, ঞ ইত্যাদি।

মহাপ্রাণ ধ্বনি

প্রত্যেক বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ ধ্বনির উচ্চারণকালে বাতাসের চাপের আধিক্য থাকে বলে এদের মহাপ্রাণ ধ্বনি বলে। যেমন: খ, ঘ; ছ, ঝ ইত্যাদি।

ধ্বনি-প্রকৃতিঅল্পপ্রাণ ধ্বনিমহাপ্রাণ ধ্বনি
অঘোষক চ ট ত পখ ছ ঠ থ ফ
ঘোষগ জ ড দ ব ঙ ঞ ণ ন মঘ ঝ ঢ় ধ ভ

পরাশ্রয়ী ধ্বনি

'ং' (অনুস্বার), 'ঃ' (বিসর্গ) এবং 'ঁ' (চন্দ্রবিন্দু) এই ধ্বনি তিনটি স্বতন্ত্রভাবে উচ্চারিত হতে পারে না বলে এদের পরাশ্রয়ী ধ্বনি বলে। এদের অযোগবহ ধ্বনিও বলে।

অ্যা ধ্বনির উচ্চারণ

উচ্চারণ একটি বাচনিক প্রক্রিয়া। ভাষায় উচ্চারণের শুদ্ধতা রক্ষিত না হলে মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। মনের ভাব প্রকাশের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনিসমষ্টিই ভাষা। দুভাবে ধ্বনি বা ভাষাকে প্রকাশ করা যায়। এক. মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে; দুই. লিখে। মনের ভাব লিখে কিংবা উচ্চারণ করে যেভাবেই প্রকাশ করা হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যথার্থ বানান ও বিশুদ্ধ উচ্চারণ অপরিহার্য। শুদ্ধ উচ্চারণ সঠিক মনোভাব প্রকাশের সহায়ক। পক্ষান্তরে, অশুদ্ধ উচ্চারণ শব্দের অর্থবিভ্রান্তি ও বিকৃতি ঘটায়। তাই শুদ্ধ উচ্চারণের গুরুত্ব অপরিসীম। শুদ্ধ উচ্চারণের ক্ষেত্রে প্রমিত কথ্য ভাষার বাচনভঙ্গির অনুসরণ প্রয়োজন। সেইসাথে স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির যথাযথ উচ্চারণ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা আবশ্যক। এ ছাড়াও ভাষা ব্যবহারে আঞ্চলিকতা পরিহার করা এবং উচ্চারণসূত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করা দরকার।

মনে রাখা প্রয়োজন প্রতিটি ধ্বনি-প্রতীকের নিজস্ব উচ্চারণ ও ধ্বনিগাম্ভীর্য রয়েছে। উল্লেখ্য, একাধিক ধ্বনি মিলে যখন শব্দ তৈরি হয়, তখন ধ্বনি-প্রতীকের উচ্চারণ কোথাও অপরিবর্তিত থাকে আবার কোথাও পরিবর্তিত বা বিকৃত হয়ে যায়। নিচে অ্যা ধ্বনির উচ্চারণরীতি উল্লেখ করা হলো।

বাংলা বর্ণমালায় বর্তমানে ব্যবহৃত স্বরবর্ণের সংখ্যা ১১টি। এগুলো হলো অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ।
প্রমিত বাংলা উচ্চারণে মৌলিক স্বরধ্বনির সংখ্যা ৭টি। এগুলো হলো: ই, এ, অ্যা, আ, অ, ও, উ। বাংলা মুখের ভাষায় স্বরধ্বনি অ্যা-ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলেও এই বর্ণের জন্য পৃথক কোনো বর্ণচিহ্ন বাংলা বর্ণমালায় নেই।

অ্যা ধ্বনির উচ্চারণ

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে 'অ্যা' ধ্বনির কোনো স্বতন্ত্র ধ্বনি-চিহ্ন নেই। কয়েকটি ক্ষেত্রে আ ধ্বনির উচ্চারণ অ্যা হয়।

১. শব্দের শুরুতে যুক্ত ব্যঞ্জনের জ্ঞ আ-কার থাকলে জ্ঞাত [গ্যাঁতো] জ্ঞান [গ্যাঁন/গ্যান] জ্ঞাপন [গ্যাঁপন]।
২. য-ফলা যুক্ত ব্যঞ্জনের সঙ্গে আ-কার বা আ-ধ্বনির উচ্চারণ প্রায় ক্ষেত্রেই অ্যা হয়। যেমন:

খ্যাতি [খ্যাতি]
ব্যাপার [ব্যাপার]
ত্যাগ [ত্যাগ্‌]
ব্যাকরণ [ব্যাকরোন্‌]

লক্ষণীয় শব্দের মধ্যে জ্ঞা থাকলে আ-ধ্বনি কখনো অ্যা, কখনো আ উচ্চারিত হয়। যেমন: বিজ্ঞান [বিগ্‌গ্যাঁন/বিগ্‌গাঁন্]

common.content_added_by

অনুশীলনী

56
56

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন: (নমুনা)

১। ব্যঞ্জন বর্ণের সংখ্যা কয়টি?
ক. ১১ টি
খ. ২৫ টি
গ. ৩৯ টি
ঘ. ৫০ টি

২। নিচের কোন বর্ণগুলো কণ্ঠধ্বনির উদাহরণ?
ক. অ, আ, ক, খ
খ. ই, ঈ, চ, ছ
গ. উ, ঊ, প, ফ
ঘ. ত, থ, দ, ধ

কর্ম-অনুশীলন

নিচের ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণস্থান ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর।

ধ্বনি
উচ্চারণস্থান
উচ্চারণস্থান অনুসারে নাম
ক, খ, গ, ঘ, ঙ, হ
চ, ছ, জ, ঝ, ঞ, য়, শ
ট, ঠ, ড, ঢ, ণ, র, ড়, ঢ়, য
ত, থ, দ, ধ, ন, ল, স
প, ফ, ব, ভ, ম
common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion