প্রাথমিক চিকিৎসা/প্রতিবিধান (পাঠ ৫)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য স্কাউটিং ও গার্ল গাইডিং | - | NCTB BOOK
108
108

প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে জানার আগে প্রাথমিক চিকিৎসা কী তা তোমরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে ধারণা পেয়েছো। প্রাথমিক চিকিৎসা বা প্রতিবিধান চিকিৎসাশাস্ত্রের একটি অংশ। প্রাথমিক চিকিৎসা হচ্ছে হঠাৎ কোনো পীড়া বা দৈব দুর্ঘটনায় হাতের কাছের জিনিসের দ্বারা রোগীকে প্রাথমিকভাবে সাহায্য করা, যাতে ডাক্তার আসার আগে রোগীর অবস্থার অবনতি না ঘটে বা জটিলতা সৃষ্টি না হয়। অর্থাৎ যেকোনো আকস্মিক দুর্ঘটনায় প্রথম শুশ্রুষা এবং সংক্ষিপ্ত উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা/ প্রতিবিধান বলা হয়।

রক্তক্ষরণ: রক্ত হলো এক প্রকার তরল পদার্থ। এর রং লাল। হিমোগ্লোবিন নামক লাল রঞ্জক পদার্থের উপস্থিতিতে রক্তের রং লাল দেখায়। শরীরের কোনো স্থানে আঘাতের ফলে বা কেটে গেলে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, এবং সেই ক্ষত হতে যে রক্ত বের হয়, তাকে রক্তক্ষরণ বা রক্তপাত বলে। বিভিন্নভাবে রক্তক্ষরণ হতে পারে যেমন-

১। মুখ দিয়ে রক্ত পড়া : মুখের ভিতরের যেকোনো অংশ থেকে রক্তপাত হলে বরফ চুষতে হবে। তাহলে রক্তপাত বন্ধ হবে। এরপর রোগীকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে হবে।

২। নাক দিয়ে রক্ত পড়া : আঘাতজনিত বা অন্য কোনো কারণে কারো নাক দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করলে তৎক্ষণাৎ তাকে চিত করে শোয়াতে হবে অথবা বসিয়ে মাথা পেছনের দিকে হেলিয়ে রাখতে হবে। কাপড়চোপড় ঢিলা করে দিতে হবে। নাকের সামনে ও ঘাড়ের পিছনে ঠান্ডা কমপ্রেস দিতে হবে। তখন মুখ দিয়ে শ্বাসকার্য চালাতে হবে। রক্তপাত বন্ধ হবার পরও কিছুক্ষণ নাকের ছিদ্রপথে তুলো দিয়ে রাখতে হবে।

৩। শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে: কাটা স্থানটি কিছুক্ষণ পরিষ্কার হাতে চেপে ধরতে হবে। রক্ত বন্ধ হলে ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে। সাধারণত তিনটি উৎস থেকে রক্তপাত হয়। যথা-
ক) কৈশিক নালি (Capillary) একটানা স্রোতের ন্যায় রক্ত বের হয়।
খ) শিরা (Vein)-গলগল করে রক্ত বের হয়।
গ) ধমনী (Artery) ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়।
দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ রক্তপাত হয় কৈশিক নালি থেকে।

রক্তপাতের প্রাথমিক চিকিৎসা:
১। রোগীকে বসানো ও শোয়ানো যায় এমন স্থানে স্থানান্তর করতে হবে। এতে রক্তপাত আপনা-আপনি কমে যাবে।
২। যে স্থান হতে রক্তপাত হচ্ছে, সে স্থান হৃৎপিন্ডের সমতার উপর তুলে ধরলে রক্তপাত অনেকটা কমে যাবে।
৩। সামান্য কেটে গেলে ঐ স্থানে রক্ত জমাট বেঁধে আপনা-আপনি রক্তপাত বন্ধ হয়।
৪। কাটা স্থানে বৃদ্ধাঙ্গুলির চাপ প্রয়োগ করলে অনেক সময় রক্তপাত বন্ধ হয়।
৫। আহত অঙ্গের নড়াচড়া বন্ধ করতে হবে।
৬। রক্তপাতের স্থানে বরফ ব্যবহার করতে হবে।
৭। রক্তপাত বধের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ দিতে হবে।
৮। ক্ষতস্থান পরিষ্কার কাপড় বা ব্যান্ডেজ দিয়ে বাঁধতে হবে।
৯। তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে নিতে হবে।
১০। বেশি রক্তপাত হলে টুর্নিকেট ব্যবহার করতে হবে। টুর্নিকেট অর্থ হলো প্রাথমিক বাঁধনকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শক্ত করে তোলা। ক্ষতস্থান ঢিলা করে বেঁধে তার ভিতরে একটি কাঠি বা পেনসিল ঢুকিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে ঘুরালে বাঁধনটি ক্রমশ শক্ত হয়ে রক্তপাত বন্ধ হয়।

বৈদ্যুতিক শক: আজকাল শহর ও শহরতলি এবং গ্রামেও বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে। বহু জায়গায় অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার ফলে যেকোনো সময় তড়িতাহত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বিদ্যুৎপ্রবাহ বা কারেন্ট দুই ধরনের। এসি (AC) কারেন্ট ও ডিসি (DC) কারেন্ট। এসি কারেন্ট আকর্ষণ করে টেনে নেয়। ডিসি কারেন্ট শুধু ধাক্কা দেয়। সে জন্য এসি কারেন্ট বেশি মারাত্মক। ভেজা কাপড় বা গাছের সাথে বিদ্যুৎপ্রবাহের সংযোগের ফলে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এগুলো স্পর্শ করলে নিজেও তড়িতাহত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে: কারো শরীরে বিদ্যুতের তার জড়িয়ে গেলে বা কেউ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে সাথে সাথে মেইন সুইচ কন্ধ করে দিতে হবে। কোনো কারণে সুইচ বন্ধ করতে না পারলে শুকনা কাঠ দিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে ছাড়িয়ে দিতে হবে। কাঠ না পেলে শুকনা কাপড় হাতে জড়িয়ে ধাক্কা দিতে হবে। কখনো খালি হাতে ধরলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিপদ ঘটতে পারে। কখনো গায়ে পানি দেবে না। শ্বাসক্রিয়া না চললে কৃত্রিমভাবে শ্বাসকার্য চালাতে হবে। তাড়াতাড়ি ডাক্তার দেখাতে হবে।

মচকানো: হাড়ের সংযোগ স্থান সঞ্চালনের সময় হঠাৎ মচকে গেলে বা বেঁকে গেলে সংযোগ স্থান সংলগ্ন স্নায়ুতন্ত্রের ওপর টান পড়ে বা ছিঁড়ে গিয়ে যে অসুবিধার সৃষ্টি হয় তাকে মচকানো বলে। ব্যায়াম, খেলাধুলা বা অন্যান্য কাজকর্মের সময় মাঝে মাঝে ব্যথা পাওয়া বা মচকানো অস্বাভাবিক নয়। এসব দুর্ঘটনার জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু অনেক সময় চিকিৎসকের সাহায্য পেতে দেরি হয়। তাই আহত ব্যক্তির প্রাথমিক চিকিৎসার দরকার হয়।

লক্ষণ:
১। আহত স্থানে ব্যথা অনুভূত হবে।
২। সন্ধিস্থল ফুলে যাবে।
৩। আহত স্থান বিবর্ণ হয়ে নীল বা লাল আকার ধারণ করবে।
৪। স্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করা যাবে না এবং চলার সময় আহত স্থানে ব্যথা বৃদ্ধি পাবে।

প্রাথমিক চিকিৎসা:
১। আঘাতের সাথে সাথে আহত স্থানে ঠান্ডা পানি বা বরফ লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
২। আহত স্থানটি নড়াচড়া করতে দেওয়া যাবে না।
৩। মচকানো স্থানটি যথাসম্ভব আরামদায়ক অবস্থায় রাখতে হবে।
৪। আহত স্থানে হাড়ভাঙার ব্যান্ডেজ প্রয়োগ করতে হবে।
৫। ব্যান্ডেজ সব সময় ভিজা রাখবে। সম্ভব হলে বরফ লাগাবে।
৬। মাংসপেশি মচকে গেলে রোগীকে সহজ ও আরামদায়ক অবস্থায় শোয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
৭। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীকে ডাক্তার বা হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে।

কামড়, দংশন বা হুল ফোটা: বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারের কামড় থেকে সাবধান থাকতে হবে। পাগলা কুকুরের মুখের লালায় জলাতঙ্ক রোগের জীবাণু থাকে। কুকুর, নেকড়ে, শিয়াল, বেজি ও ছুঁচো-এরা সবাই জলাতঙ্ক রোগের জীবাণু বহন করে। এরা কামড়ালে সাথে সাথে আহত স্থানে কার্বলিক সাবান বা পানি দিয়ে আহত স্থানটি ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে এবং তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে। বিড়ালের নখ খুব তীক্ষ্ণ। বিড়াল থেকে ডিপথেরিয়া রোগ হয়। বিছা, মৌমাছি ও ভীমরুলের কামড় মারাত্মক। এরা হুল ফুটিয়ে বিষ থলি থেকে হুলের পথে বিষ ঢেলে দেয়। অনেক সময় তুলটি ভেঙে গিয়ে দংশন স্থানে লেগে থাকে। যদি হুল ফুটে থাকে তবে ক্ষতের চারদিকে চাপ দিয়ে হুলটি বের করে নিতে হবে।

সাপে কামড়ালে কামড়ের জায়গার উপরে কাপড় বা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধতে হবে। এর ফলে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হবে এবং বিষ ছড়াতে পারবে না। ধারালো ব্লেড দিয়ে আহত জায়গা একটু গভীর করে কেটে (আধা সে: মি:) রক্ত বের করে ফেলতে হবে। ৩০ মিনিটের বেশি সময় বেঁধে রাখা যাবে না। বেশি সময় বেঁধে রাখলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে নিচের অংশে পচন ধরতে পারে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের নিকট বা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

চোখে কিছু পড়লে : চোখ মানুষের অমূল্য সম্পদ। নানা কারণে চোখ দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারে। চোখে ধুলোবালি পড়তে পারে। কাজ করার সময় কিছু ছিটকে এসে চোখে বিঁধতে পারে, কোনো রাসায়নিক পদার্থ চোখে পড়তে পারে। এরূপ কিছু চোখে পড়ে গেলে-

১। কখনই চোখ কচলানো যাবে না।
২। চোখে পানির ঝাপটা দিতে হবে।
৩। রোগীকে আলোর দিকে মুখ করে বসিয়ে আলতোভাবে চোখের দুটি পাতা খুলে দেখতে হবে। চোখে কোনো বস্তু লেগে থাকলে রুমালের কোনা ভিজিয়ে আলতোভাবে ব্রাশ করার মতো লাগিয়ে বস্তুটি তুলে নিতে হবে।
৪। রাসায়নিক কিছু চোখে পড়লে দুধ দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
৫। তাড়াতাড়ি ডাক্তার বা হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে।

কানে কিছু গেলে: কানে পোকামাকড় ঢুকে গেলে সরিষার তেল বা অলিভ ওয়েল অল্প পরিমাণ ঢেলে দিলে পোকা মরে যায় এবং বের হয়ে আসে। তাছাড়া মার্বেল জাতীয় কোনো কিছু ঢুকে গেলে নড়াচড়া না করে দ্রুত ডাক্তারের নিকট বা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

অজ্ঞান অবস্থায় করণীয় : দেহের স্নায়ুতন্ত্রের কাজের বিঘ্ন ঘটলে রোগীর জ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায়। এ অবস্থাকে অজ্ঞান বা অচেতন অবস্থা বলে। বিভিন্ন কারণে মানুষ অজ্ঞান হয় যেমন- রোগবশত, দুর্ঘটনাজনিত, বিষক্রিয়াজনিত এবং তাপের তারতম্যজনিত কারণে। এ অবস্থায় প্রাথমিকভাবে যা করতে হবে-

১। রোগীকে ফাঁকা ও বায়ুপূর্ণ স্থানে নিয়ে যেতে হবে।
২। রোগীর জামা-কাপড়, জুতা, মোজা, কৃত্রিম দাঁত থাকলে খুলে নিতে হবে।
৩। রোগীকে চিৎ করে শুইয়ে পর্যবেক্ষণ করে কী করণীয় তা স্থির করতে হবে।
৪। লোক বেশি হলে সরাতে হবে।
৫। রক্তক্ষরণ হলে তার প্রতিবিধান করতে হবে।
৬। কোনো উত্তেজক পানীয় বা খাদ্য খাওয়ানো যাবে না।
৭। বিষজনিত কারণে অজ্ঞান হলে রোগীকে উপুড় করে বুকের নিচে বালিশ দিয়ে শুইয়ে দিতে হবে। রোগীর দুটি পা হাঁটু হতে উপরের দিকে ভাঁজ করে দিতে হবে।
৮। জ্ঞান ফেরার জন্য মুখে পানির ঝাপটা দিতে হবে। গরম চা বা কফি খাওয়াতে হবে।
৯। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।

কাজ-১: বাড়িতে, বাড়ির বাইরে, খেলার মাঠে ঘটতে পারে এমন কয়েকটি দুর্ঘটনার নাম উল্লেখ কর।
কাজ-২: খেলার মাঠে আঘাত পেয়ে নাক দিয়ে রক্ত পড়লে প্রাথমিক চিকিৎসা কীভাবে দেওয়া হয় তা বর্ণনা কর।
কাজ-৩: গত তিন মাসে তোমাদের বাড়িতে কেউ দুর্ঘটনায় পড়েছিল কি না তা নিচের ছকে পূরণ কর (দলগত কাজ)
পরিবারের সদস্যদুর্ঘটনার ধরন
১। মা
২। বাবা
৩। বোন
৪। ভাই
৫। গৃহকর্মী
common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion