ইতোমধ্যেই জেনেছো যে, জলবায়ু হলো কোনো স্থানের বহুদিনের আবহাওয়ার গড় বা সামগ্রিক অবস্থা। বাংলাদেশের জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র। তোমরা জান যে, বাংলাদেশে বেশ গরম পড়ে ও তেমন শীত পড়ে না। শীতকাল বেশ ছোটো, সাধারণত পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস শীত পড়ে। তারপর শীত কমে গিয়ে ধীরে ধীরে আবহাওয়া উষ্ণ হতে থাকে। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে বেশ গরম পড়ে। এই দুই মাসকে আমরা গ্রীষ্মকাল বলি। বৈশাখ মাসে প্রতিবছরই কালবৈশাখী দেখা যায়। ও আষাঢ়ের শুরু থেকে বৃষ্টি শুরু হয় অর্থাৎ বর্ষাকাল শুরু হয়। শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে বেশ গরম ও বৃষ্টি পড়ে। তারপর আবার আবহাওয়া ঠান্ডা হতে থাকে এবং পৌষ মাসে শীত ফিরে আসে। এটাই বাংলাদেশের জলবায়ুর স্বাভাবিক রূপ। এরকম আবহাওয়া তোমার বাবা-মা যখন ছোট ছিলেন তখনও দেখা যেত। বিশ বা ত্রিশ বছর ধরে বাংলাদেশের সামগ্রিক আবহাওয়া অর্থাৎ জলবায়ু একই রকম।
কোনো স্থানের জলবায়ু সহসা পরিবর্তন হয় না। তবে বিজ্ঞানীরা পরিমাপ করে দেখতে পেয়েছেন যে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা এভাবে বেড়ে যাওয়াকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন (Global warming) বলে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পর্বতের চূড়ার ও মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে। তাপমাত্রা বেড়ে সমুদ্রের পানি প্রসারিত হচ্ছে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে পানির উচ্চতা বাড়তে থাকবে। ফলস্বরূপ, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ বিশ্বের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে যাবে। এছাড়া তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বিরূপ আবহাওয়া, যেমন খরা, অতিবৃষ্টি এবং প্রাকৃতিক দূর্যোগ বেশি বেশি ঘটতে দেখা যাবে।
চিত্র-১৪.৩: বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণ
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মূল কারণ বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি। এ অধ্যায়েই তোমরা জেনেছো যে, কার্বন ও অক্সিজেন চক্রাকারে ফিরে আসে বলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের ভারসাম্য বজায় থাকে। কিন্তু ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে, কলকারখানা ও যানবাহনে কয়লা, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানো হচ্ছে। এসব জ্বালানি পোড়ানো থেকে উৎপন্ন কার্বন ডাইঅক্সাইড কোনোভাবে ব্যয় বা শোষিত হচ্ছে না। বরং মানুষ বাড়ার ফলে এবং অন্যান্য কারণে গাছপালা কমে যাচ্ছে। ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড বেড়ে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কার্বন ডাইঅক্সাইড বেড়ে গেলে কেন তাপমাত্রা বাড়ছে?
কাজ: গ্রিনহাউজ প্রভাব প্রয়োজনীয় উপকরণ: দুটি সমান মাপের পানির গ্লাস, মাপচোঙ, পানি, একটি পরিষ্কার স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ব্যাগ ও দুটি থার্মোমিটার। পদ্ধতি: ১. দুটি গ্লাসে মাপচোঙ দিয়ে মেপে সমান পরিমাণ পানি নাও। ২. প্রতিটি গ্লাসে একটি করে থার্মোমিটার রাখো। থার্মোমিটারে দেখো পানির তাপমাত্রা কত। তোমাদের খাতায় লিখে নাও। ৩. একটি গ্লাস প্লাস্টিকের ব্যাগের ভিতর রেখে ব্যাগের মুখটি আটকে দাও। ৪. দুটি গ্লাস এবার রোদে রেখে দাও। অনুমান কর তো কোনটির পানি বেশি গরম হবে? তোমাদের উত্তরের পক্ষে যুক্তি দাও। ৫. এক ঘণ্টা পরে থার্মোমিটারে দেখো গ্লাস দুটির তাপমাত্রা কত। কোনটির তাপমাত্রা বেশি বেড়েছে? তোমাদের অনুমানের সাথে মিলেছে কি? না মিললে তার কারণ ব্যাখ্যা কর। |
দেখা যাবে, যে গ্লাসটি প্লাস্টিকের ব্যাগের ভিতর ছিল তার তাপমাত্রা বেশি বেড়েছে। কেন তা বলতে পার? সূর্যের তাপ দুটি গ্লাসের পানির উপর সমানভাবে পড়ছে। যে গ্লাসটি প্লাস্টিকের ব্যাগের ভিতরে আছে সেটিতে সূর্যালোকের সাথে তাপ প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু প্লাস্টিকের ব্যাগ ভেদ করে ভিতরের তাপ পুরোপুরি বের হতে পারে না। ফলে প্লাস্টিকের ব্যাগের ভিতরে পানি তাড়াতাড়ি গরম হয় অর্থাৎ তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ে।
শীতপ্রধান দেশে তীব্র শীতে গাছপালা টিকে থাকতে পারে না। তীব্র শীতে শাক-সবজি ফলানোর জন্য কাঁচের ঘর তৈরী করা হয়, যাকে গ্রিনহাউজ বলা হয়। শীতকালে অল্পসময় যখন রোদ থাকে, তখন রোদের তাপ কাচ ভেদ করে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে এবং ঘরের বায়ু, গাছ ও মাটিকে উত্তপ্ত করে। ঘরের ভিতরের উত্তপ্ত বায়ু, মাটি, গাছ, ইত্যাদি যে তাপীয় বিকিরণ করে তা কাচকে ভেদ করে পুরাপুরি বের হয়ে যেতে পারে না। ফলে কাঁচের ঘর রাতের বেলায়ও গরম থাকে এবং ভিতরের শাক-সবজি বেঁচে থাকে। কাচের ঘরের ভিতরে এভাবে তাপ থেকে যাওয়ার বিষয়টিকে গ্রিনহাউস প্রভাব বলে।
চিত্র-১৪.৪: গ্রিনহাউস
পৃথিবীটাকে একটি গ্রিনহাউসের মতো ধরা যায়। পৃথিবীর চারদিক ঘিরে আছে বায়ুমন্ডল। এ বায়ুমন্ডলে আছে কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন আর জলীয়বাষ্প। এরা সূর্যের তাপ পৃথিবীতে আসতে কোনো বাঁধা দেয় না, ফলে সূর্যের তাপে পৃথিবী উত্তপ্ত হয়। কিন্তু এরা উত্তপ্ত পৃথিবী থেকে তাপকে বিকিরিত হয়ে চলে যেতে বাধা দেয়। ফলে পৃথিবী রাতের বেলায়ও গরম থাকতে পারে। এসব গ্যাসকে গ্রিনহাউস গ্যাস বলে। কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন আর জলীয়বাষ্প বায়ুমন্ডলে রয়েছে- এটি মানব সভ্যতার জন্য আশীর্বাদ। কারণ এসব গ্যাস না থাকলে পৃথিবী থেকে তাপ বিকিরিত হয়ে মহাশূন্যে চলে যেত আর পৃথিবী ভীষণ ঠান্ডা হয়ে পড়তো। এখন প্রশ্ন হলো আশীর্বাদ আবার কীভাবে সমস্যা হলো? সমস্যা হলো বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড বেশি থাকায় এরা বেশি বেশি তাপ ধরে রাখতে পারছে। তাই পৃথিবীর তাপমাত্রা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য মূল কারণ বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ
জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে কী করণীয়?
জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণ জানলে তোমরা। উপরের আলোচনা থেকে আমরা নিচের প্রবাহ চিত্রটি আঁকতে পারি।
উপরের প্রবাহচিত্র থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণ বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও মিথেন গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি। তাহলে কীভাবে আমরা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আর জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে পারি? সহজ উত্তর হলো কার্বন ডাইঅক্সাইড ও মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ কমিয়ে। অথবা কোনভাবে এদেরকে বায়ুমণ্ডল থেকে সরিয়ে নেওয়া। মিথেন গ্যাসকে বায়ুমণ্ডল থেকে সরানো যায় না। এর উৎপাদন বা নিঃসরণও বন্ধ করা কঠিন। কারণ এটি উৎপাদিত হয় কৃষিকাজ থেকে। বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবেলায় প্রধান সুপারিশ হলো কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ কমানো। কয়লা, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানো কমিয়ে তার বদলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি (যেমন-সৌরশক্তি, বায়ুপ্রবাহ, ইত্যাদি) ব্যবহার করলে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ কমে যাবে। বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাইঅক্সাইড কমানোর জন্য আরেকটি উপায়ের কথা বলা হয়। তা হলো বেশি করে গাছ লাগানো। কারণ গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে খাদ্য তৈরি করে। ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড কমে আসে।
এ অধ্যায়ে আমরা যা শিখলাম
common.read_more