শক্তির ব্যবহার (সপ্তম অধ্যায়)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - | NCTB BOOK
184
184

দৈনন্দিন জীবনে আমরা বিভিন্ন কাজের সাথে জড়িত। কাজের সাথে সম্পর্ক রয়েছে শক্তি ও ক্ষমতার। এছাড়া রয়েছে শক্তির বিভিন্ন রূপ এবং এদের এক রূপ থেকে অন্যরূপে রূপান্তরের প্রক্রিয়া। পাশাপাশি রয়েছে নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার। এছাড়া শক্তির সংকট নিরসনে আমাদের শক্তির সংরক্ষণের পাশাপাশি বিকল্প শক্তির সন্ধান করতে হচ্ছে।

এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা

  • শক্তি ও কাজ ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • শক্তির বিভিন্ন রূপ ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • শক্তির রূপান্তরের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে পারব।
  • নবায়নযোগ্য শক্তির সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • অনবায়নযোগ্য শক্তির সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • শক্তির সংরক্ষণশীলতা ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • শক্তির সংকট নিরসনের উপায় ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • আমাদের জীবনে শক্তির প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করতে পারব।
  • শক্তি ব্যবহারে নিজে সচেতন হব এবং অন্যদের সচেতন করব।
common.content_added_by

কাজ, ক্ষমতা ও শক্তি (পাঠ ১)

102
102

আমরা প্রথমে নিচের চিত্রগুলোর দিকে লক্ষ করি।

উপরের চিত্রগুলো দেখে কী মনে হচ্ছে? প্রথম ছবিতে যে একজন শিক্ষার্থী একটি দেয়ালে ধাক্কা দিচ্ছে। আসলে সে কি কোনো কাজ করছে? দ্বিতীয় ছবিতে যে ফুটবল খেলছে, সে কি কোনো কাজ করছে? আর তৃতীয় ছবিতে যে মাথায় বোঝা নিয়ে দাঁড়িয়ে সে কি কোনো কাজ করছে? সাধারণ অর্থে আমাদের কাছে উপরের প্রত্যেকটি উদাহরণকেই কাজ করা মনে হচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় কাজের একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে। সহজ কথায়, কাজ তখনই হবে যখন কোনো বস্তুর উপর বল প্রয়োগে তার অবস্থানের পরিবর্তন হবে। তাহলে উপরের উদাহরণ থেকে দেখা যায়, যে শিক্ষার্থী দেয়ালে ধাক্কা দিচ্ছে তার কোনো অবস্থান পরিবর্তন হচ্ছে না বা যে মাথায় বোঝা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারও কোনো অবস্থানের পরিবর্তন হচ্ছে না। ফলে বিজ্ঞানের ভাষায় এই দুই ক্ষেত্রে নিয়ে কাজ সংঘটিত হচ্ছে না। এখানে যে ফুটবল খেলছে তার এবং ফুটবলেরও অবস্থান পরিবর্তন হচ্ছে; ফলে সে কাজ করছে। বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা বলতে পারি কোনো বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করে বস্তুটিকে বলের দিকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরানো হলে কাজ সম্পন্ন হয়। কাজের সাথে দুটি বিষয় সম্পর্কযুক্ত, একটি হলো বল এবং অপরটি হল বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন। বিজ্ঞানের ভাষায় কাজ হলো বল ও বস্তু কর্তৃক বলের দিকে অতিক্রান্ত দূরত্বের গুণফল।

একজন রিকশাচালককে রিকশা চালিয়ে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে কাজ করতে হয়। ধরা যাক, একই দূরত্ব যেতে একজন রিকশাচালকের ১০ মিনিট লেগেছে, আবার অন্যজনের লেগেছে ১৫ মিনিট। এখানে দুইজনের মধ্যে কাজ করার হার বেশি কার? তাড়াতাড়ি কাজ করার সাথে 'ক্ষমতা' ব্যাপারটি জড়িত। কোনো কাজ করার হারকে ক্ষমতা বলে। কোনো রিকশাচালক কোন জায়গায় কম সময়ে গেলে তিনি বেশি ক্ষমতা ব্যবহার করেন। অর্থাৎ আমরা ক্ষমতা পাই মোট কাজকে মোট সময় দিয়ে ভাগ করে।

কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি ব্যাপার দেখা যাক। দুজন শিক্ষার্থী সিদ্ধান্ত নিল যে তারা স্কুলের খেলার মাঠটিকে মোট পাঁচবার প্রদক্ষিণ করবে। শুরু করার কিছুক্ষণ পর দেখা গেল একজন দুবার প্রদক্ষিণ করে বসে পড়ল, আরেকজন পাঁচবারই প্রদক্ষিণ করল। এখানে আমরা কাজ করার সামর্থ্যকে বিবেচনা করব। এদের মধ্যে যে দুবার প্রদক্ষিণ করার পর বসে পড়ল, সে কাজ করার সামর্থ্য ফুরিয়ে ফেলল। আর যে পাঁচবারই প্রদক্ষিণ করল, তার কাজ করার সামর্থ্য বেশি। বিজ্ঞানের ভাষায় কাজ করার এই সামর্থ্যই হলো শক্তি। এখানে দেখা যাচ্ছে যে কাজের সাথে শক্তি সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।

শক্তি ও কাজ মূলত ভিন্ন কিছু নয়। কাজ করার জন্যই প্রয়োজন হয় শক্তির। যার যত বেশি শক্তি সে তত বেশি কাজ করতে পারে। এই কাজ এর পরিমাণ দিয়েই শক্তিকে পরিমাপ করা হয়। কাজের এককই হলো শক্তির একক। শক্তির একক হলো জুল (Joule)।

common.content_added_by

শক্তির বিভিন্ন রূপ (পাঠ ২-৩)

76
76

আমাদের কাজ করার সামর্থ্যের জন্য যে শক্তির প্রয়োজন হয় তা আমরা কোথা থেকে পাই? এটা আমরা সকলেই হয়তো জানি যে পৃথিবীতে সকল শক্তির উৎসই হলো সূর্য। তাছাড়া আমাদের চারপাশে রয়েছে শক্তির বিভিন্ন উৎস। যেমন তোমরা নিশ্চয় গ্যাস দিয়ে রান্না করতে দেখেছ। আবার দেখেছ কিভাবে তেলকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মূলত উভয় ক্ষেত্রেই আমরা গ্যাস বা তেলকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে শক্তির জোগান দিয়েছি। এখন আমরা বিভিন্ন প্রকার শক্তিররূপ নিয়ে কথা বলব।

যান্ত্রিক শক্তি

মনে কর তুমি দৌড়াচ্ছ বা একটি গাড়ি চলছে। এই দুই ক্ষেত্রেই গতি আনতে কাজ করতে হচ্ছে। আবার তুমি একটি ইট নিচ থেকে উপরে উঠিয়ে ছেড়ে দিলে অথবা গুলতি দিয়ে একটি আম পাড়ার চেষ্টা করছ। এখানে তুমি ইটটিকে উপরে উঠানোর পর এতে শক্তি সঞ্চিত হয়েছে। ইটটি ছেড়ে দিলে তা নিচের দিকে পড়তে থাকে এবং গতিশক্তি অর্জন করে। এই গতিশক্তি আসে সঞ্চিত শক্তি রূপান্তরের ফলে। আবার গুলতিকে প্রথমে পিছনে টানার পর যে শক্তি সঞ্চিত হয়, তা দিয়েই গুলতির পাথরটি দ্রুত গিয়ে আমটিকে আঘাত করে। এই যে দৌড়ানো, গাড়ি চলা, ইট উঠানো বা গুলতি দিয়ে আম পাড়া এর প্রত্যেকটির সাথেই এক ধরনের শক্তির সম্পর্ক রয়েছে। এই বিশেষ ধরনের শক্তিই হলো যান্ত্রিক শক্তি। যদিও এতে স্থিতিশক্তি ও গতিশক্তি ব্যাপারটি আলাদাভাবে জড়িত। গতির জন্য কাজ করার সামর্থ্য হল গতিশক্তি। যেমন, দৌড়াতে থাকা মানুষ বা চলন্ত গাড়ির শক্তি। আবার কোনো বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তনের জন্য সঞ্চিত শক্তি হলো স্থিতি শক্তি। যেমন ইট উপরে উঠালে বা গুলতিকে টেনে ধরলে যে শক্তি সঞ্চিত হয় তা স্থিতিশক্তি।

রাসায়নিক শক্তি

খাদ্যে বা জ্বালানিতে যে শক্তি জমা থাকে তাকে রাসায়নিক শক্তি বলে। আমাদের দেহের জন্য প্রয়োজনীয় তাপ ও গতি শক্তি আমরা খাদ্যে সঞ্চিত রাসায়নিক শক্তি থেকে শ্বসনের মাধ্যমে পাই। পেট্রোল, গ্যাস, কাঠ, কয়লা ইত্যাদি সব কিছুরই রয়েছে রাসায়নিক শক্তি। আমরা টর্চ বাতি বা রেডিয়োতে যে ব্যাটারি ব্যবহার করি তার মধ্যেও রয়েছে রাসায়নিক শক্তি।

তাপ শক্তি

রান্না করতে, মোটর গাড়ি বা রেলগাড়ির ইঞ্জিন চালাতে যে শক্তি ব্যবহার করা হয় তাকে বলে তাপশক্তি। কয়লা, গ্যাস, কাঠ, পেট্রোল বা ডিজেল পুড়িয়ে এই শক্তি পাওয়া যায়। আবার সূর্য থেকেও সরাসরি তাপ আসে। এই তাপশক্তি পৃথিবীকে উষ্ণ রাখে। তাপ শক্তি ছাড়া কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ বেঁচে থাকতে পারত না।

চুম্বক শক্তি

শক্তির আরেক রূপ হচ্ছে চুম্বক শক্তি। এই শক্তি দিয়েই কোনো চুম্বক একটি লোহার বস্তুকে আকর্ষণ করে।

আলোক শক্তি
তাপ শক্তির সাথে সূর্য থেকে সরাসরি আর যে শক্তিটি আসে তা হচ্ছে আলোকশক্তি। আলোকশক্তি ছাড়া আমরা কিছুই দেখতে পারি না। সূর্য আলোক শক্তির প্রধান উৎস। আগুন ও বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালালেও আমরা আলোক শক্তি পাই।

শব্দ শক্তি
আমরা যখন কথা বলি, গান করি বা বাঁশি বাজাই, তখন এক ধরনের শক্তি উৎপন্ন করি। এর নাম শব্দ শক্তি। শব্দ শক্তির সাহায্যেই আমরা একে অপরের কথা শুনতে পাই। টেলিফোন, রেডিও, টেলিভিশনে শব্দ শক্তি ব্যবহার করা হয়। পদার্থের কম্পন থেকে শব্দের উৎপত্তি হয়।

বিদ্যুৎ শক্তি
শক্তির একটি অতি পরিচিত এবং প্রয়োজনীয় রূপ হচ্ছে বিদ্যুৎশক্তি। বিদ্যুৎশক্তি দিয়ে আমরা বাতি জ্বালাই, পাখা চালাই। কল-কারখানায় বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহৃত হয়। অনেক দেশে রেলগাড়িও বিদ্যুৎ দিয়ে চলে। বিদ্যুৎ শক্তি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় তারের সাহায্যে নিয়ে যাওয়া যায়।

পারমাণবিক শক্তি
আমরা জানি যে, পদার্থ পরমাণু দিয়ে গঠিত। পরমাণুর কেন্দ্রে কণিকাসমূহ অত্যন্ত শক্তিশালী বল দ্বারা একত্রে অবস্থান করে। শক্তি প্রয়োগে কণিকাসমূহকে বিচ্ছিন্ন করে পাওয়া যায় পারমাণবিক শক্তি। এরা পরমাণুর অভ্যন্তরে অত্যন্ত শক্তিশালী বল দিয়ে একত্রে বাঁধা রয়েছে। এই শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করে কাজে লাগানো যায়।

common.content_added_by

শক্তির রূপান্তর (পাঠ ৪-৫)

98
98

আমরা আগেই জেনেছি মহাবিশ্বে শক্তি বিভিন্ন রূপে বিরাজ করে এবং এই বিভিন্ন রূপ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। আমরা নিচের চিত্রটি খেয়াল করি।

উপরের চিত্রানুসারে একজন ভার উত্তোলক বিভিন্ন খাবার গ্রহণের ফলে তার খাবারগুলো ভেঙে রাসায়নিক শক্তি উৎপন্ন হয়। তিনি যখন ভারটিকে উঠাতে চেষ্টা করছেন তখন রাসায়নিক শক্তি গতিশক্তিতে পরিবর্তিত হতে থাকে। এরপর তিনি যখন ক্রমশ ভারটিকে মাথায় তুলছেন তার গতিশক্তি ক্রমশ ভার ও ভূপৃষ্ঠের মধ্যের স্থিতি শক্তিতে পরিণত হতে থাকে। আবার যখন তিনি ভারটিকে নিচে ফেলে দিচ্ছেন তখন স্থিতি শক্তি গতি, শব্দ ও তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কারণ ভার মাটিতে পড়ার সাথে শব্দ উৎপন্ন হয় এবং ভারটিতে হাত দিয়ে স্পর্শ করলে দেখা যাবে সেটি গরম লাগছে। অর্থাৎ আমাদের শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রমে নানাবিধ শক্তির রূপান্তর ঘটছে।

এভাবেই শক্তির বিভিন্ন রূপ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত থাকে। নিম্নে শক্তির রূপান্তরের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:

যান্ত্রিক শক্তির রূপান্তর
হাত দিয়ে শরীরের অন্য কোনো অংশ ঘষলে গরম অনুভূত হয়। এতে যান্ত্রিক শক্তি তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। বাঁশি বাজালে যান্ত্রিক শক্তি শব্দশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এক খন্ড পাথরের উপর একটি ধাতব দণ্ড দ্বারা জোরে আঘাত করলে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের হতে দেখা যায় এবং এক ধরনের শব্দেরও সৃষ্টি হয়। ধাতব দন্ড ও পাথর খন্ডটি খানিকটা উত্তপ্ত হয়। এক্ষেত্রে যান্ত্রিক শক্তি তাপ, শব্দ ও আলোকশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। ঢেঁকি দিয়ে ধান ভাঙ্গার সময় এতে যান্ত্রিক শক্তি শব্দ ও তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। একই ভাবে দোলনার ক্ষেত্রে স্থিতি ও গতিশক্তির রূপান্তর ঘটে থাকে।

তাপশক্তির রূপান্তর
বাষ্পীয় ইঞ্জিনে তাপের সাহায্যে উৎপন্ন শক্তি ব্যবহার করে রেলগাড়ি চালানো হয়। এখানে তাপশক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

আলোকশক্তির রূপান্তর

ফটোগ্রাফিক কাগজের উপর আলোর ক্রিয়ার ফলে আলোকশক্তি রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। সূর্যের আলোকে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক শক্তিতে পরিণত করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি যেমন পকেট ক্যালকুলেটর, রেডিয়ো ও ইলেকট্রনিক ঘড়িতে সৌর শক্তিকে তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করে ব্যবহার করা হয়।

শব্দ শক্তির রূপান্তর

শব্দোত্তর তরঙ্গ দ্বারা জামা কাপড়ের ময়লা পরিষ্কার করা হয়। এসব ক্ষেত্রে শব্দশক্তি যান্ত্রিকশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। অনুনাদের সময় শব্দ শক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আবার টেলিফোন ও রেডিওর প্রেরক যন্ত্রে শব্দ শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে পরিণত করে।

চৌম্বক শক্তির রূপান্তর

লোহাকে দ্রুত ও বারবার চুম্বক এবং বিচুম্বকরনকালে তাপ উৎপন্ন হয়।
এতে চৌম্বক শক্তি তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তাছাড়া তড়িৎ চুম্বকের সাহায্যে ভারী জিনিসপত্র উঠানো যায়। এতে চৌম্বকশক্তি যান্ত্রিকশক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

বিদ্যুৎশক্তির রূপান্তর

বৈদ্যুতিক ইস্ত্রিতে বিদ্যুৎ চালনা করলে তাপ উৎপন্ন হয়। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ শক্তি তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। বৈদ্যুতিক পাখার মধ্যদিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে পাখা ঘুরতে থাকে। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ শক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। বৈদ্যুতিক বাল্ব বা LED লাইট জ্বললে বিদ্যুৎ শক্তি হতে আমরা আলো পাই।

রাসায়নিক শক্তির রূপান্তর

কয়লা পোড়ালে তাপ উৎপন্ন হয়। রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে তা ঘটে। এক্ষেত্রে রাসায়নিক শক্তি তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। সাধারণত বিদ্যুৎকোষে রাসায়নিক দ্রব্যের বিক্রিয়ার ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এক্ষেত্রে রাসায়নিক শক্তি বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এছাড়া কয়লা, পেট্রোল, কেরোসিন, গ্যাস ইত্যাদি পুড়িয়ে রাসায়নিক শক্তিকে তাপ ও আলোকশক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়।

পারমাণবিক শক্তির রূপান্তর

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পারমাণবিক শক্তিকে প্রাথমিকভাবে তাপশক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। তাপশক্তিকে ব্যবহার করে টারবাইন ঘুরিয়ে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। পরবর্তীতে যান্ত্রিক শক্তিকে জেনেরেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়।

common.content_added_by

শক্তির সংরক্ষণশীলতা (পাঠ ৬)

73
73

মনে কর তুমি স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে একটি টেনিস বলকে উপরের দিকে ছুড়ে মারলে। কী দেখছ? টেনিস বলটি একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় উঠার পর এটি আবার নিচে নামতে থাকে। এখানে টেনিস বলটি উপরে উঠতে থাকার সময় এর গতিশক্তি কমতে থাকে এবং স্থিতিশক্তি বাড়তে থাকে। যখন এর গতিশক্তি শূন্য হয়ে যায় তখন এটি ক্ষণিকের জন্য থেমে নিচে পড়তে শুরু করে। এটি স্থিতিশক্তির কারণে নিচে নামতে থাকে। দেখা যাবে, বস্তু যতই নিচের দিকে নামতে থাকে ততই এর স্থিতিশক্তি কমে গতিশক্তি বাড়তে থাকে এবং স্থিতিশক্তি গতিশক্তিতে পরিণত হয়। টেনিস বলটি যখন মাটি স্পর্শ করে এবং স্থির হয় তখন তার সমস্ত শক্তি শব্দ, তাপ, আলোক, ইত্যাদি শক্তিতে পরিণত হয়। আমরা তাপ বা আলোকের তেমন প্রমাণ বুঝতে না পারলেও বলটি মাটিতে স্পর্শ করায় যে শব্দ উৎপন্ন হয় তা শুনতে পাই। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে টেনিস বলের পরিবর্তে একটি পাথর উপরে ছুড়ে মারলে এটি যদি কোনো মাঠে পড়ে তবে কোনো না কোনো ক্ষেত্রে পাথরটিকে ধরলে গরম অনুভূত হতে পারে।

এতক্ষণ তোমরা জেনেছ যে শক্তি কীভাবে একরূপ থেকে অন্যরূপে পরিবর্তিত হয়। তোমাদের মনে একটা প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, এই রূপান্তরের সময় শক্তির কি কোনো অপচয় হয় না? বিস্ময়কর হলেও এটা সত্য যে শক্তির রূপান্তরের পূর্বে বা পরে মোট শক্তির পরিমাণ সমান থাকে। প্রকৃতপক্ষে আমরা কোনো নতুন শক্তি সৃষ্টি করতে পারি না, এমনকি শক্তি ধ্বংস করতেও পারি না। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সামগ্রিক শক্তির কোনো তারতম্য ঘটে না। এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রথম মূহূর্তে যে পরিমাণ শক্তি ছিল, আজও সেই পরিমাণ শক্তি বর্তমান। এটাই হলো শক্তির নিত্যতা বা সংরক্ষণশীলতা।

common.content_added_by

নবায়নযোগ্য শক্তি (পাঠ ৭-৯)

86
86

আমরা বিভিন্ন শক্তির উৎস থেকে শক্তি পাই। এসব শক্তির উৎস দু'ধরনের: নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য। নবায়নযোগ্য নাম থেকে তোমরা সহজেই বুঝতে পারবে এর অর্থ কী বুঝায়। যা কিছু নবায়ন করা যায়। এক্ষেত্রে কোনো জিনিস ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করে পুনরায় ঐ জিনিসটি দ্বারা আবার শক্তি উৎপাদন করা যায়। অর্থাৎ যে শক্তির উৎসকে বারবার ব্যবহার করা যায় সেই শক্তিকে বলা হয় নবায়নযোগ্য শক্তি। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সূর্যরশ্মি, বায়োগ্যাস, পানি, বায়ুপ্রবাহ, পানির জোয়ারভাটা, ইত্যাদি।
নিম্নে আমরা বায়োগ্যাস, সৌরশক্তি, পানির জোয়ারভাটা এবং বায়ুপ্রবাহ হতে নবায়নযোগ্য শক্তির উপাদান সম্পর্কে ধারণা লাভ করব।

বায়োগ্যাস (উদ্ভিজ ও প্রাণীজ)
গরু, ছাগল, ঘোড়া ও মহিষের বিষ্ঠা জ্বালানি হিসেবে বহু প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রাণীর এসব বিষ্ঠা শক্তির এক প্রকার উৎস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শুকনো গোবর পুড়িয়ে তাপশক্তি উৎপন্ন করা হয়। বায়োগ্যাসে যে সকল উপাদান বা বর্জ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো গরু, শূকর এবং মুরগি হতে প্রাপ্ত বর্জ্য, শস্য, পরিত্যক্ত উদ্ভিদ, ইত্যাদি। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র প্রাণিজ বা কেবলমাত্র উদ্ভিদজ উপকরণ অথবা উভয় প্রকারের মিশ্রণও ব্যবহার করতে পার। শূকর বা মুরগি রাখার জায়গা থেকে মলমিশ্রিত যে কাঁচা খড় পাওয়া যায়, সেগুলো বয়োগ্যাস তৈরির উপযুক্ত কাঁচামাল এবং এটি প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ উপকরণের ভালো মিশ্রণ। তবে এগুলো ব্যবহারের সময় ছোটো ছোটো টুকরা করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে আরম্ভ করার সময় ব্যবহারের আগে শুকনো উদ্ভিজ্জ উপকরণগুলো খুব ছোট ছোট করে কেটে অথবা পিষে খোসা বের করে নিতে হয়। আর টাটকা উদ্ভিজ্জগুলো অন্তত দশদিন বাইরে পচতে দিতে হবে।

বায়ুপ্রবাহ

আদিম মানুষ ভয় পেত বায়ুপ্রবাহ। সভ্যতার বিকাশ ও বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ফলে এই বায়ুপ্রবাহকে মানুষ বর্তমানে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছে। আদিম মানুষ চার-পাঁচটা পাখার সাহায্যে চক্র বানিয়ে বাতাসের সাহায্যে চক্র ঘুরাত। চক্রের ঘূর্ণন কাজে লাগিয়ে মানুষ কুয়া থেকে পানি তোলা, কৃষিসেচ, যব অথবা গম ভাঙ্গানো, আখ মাড়াই, ধানকাটা, খড় কাটা ইত্যাদি কাজ করত। পরে মানুষ বাতাসকে কাজে লাগিয়ে কাঠ চেরাইয়ের মতো কঠিন কাজও সম্পন্ন করেছে। পৃথিবীর বহু অঞ্চলের মানুষ আগে এ ধরনের কাজে বড়ো বড়ো চক্রাকার এক ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করত। যা বর্তমানে বায়ুকল বা উইন্ডমিল নামে পরিচিত। উইন্ডমিল চালিয়ে বহুদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।

পানির জোয়ার-ভাটা
নদী বা সমুদ্রের পানির জোয়ার-ভাটার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন যন্ত্র চালনার ব্যাপারটি অনেক দিন আগেই উদ্ভাবিত হয়েছে। কিন্তু জোয়ারভাটার শক্তিকে তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তরের ব্যাপারটি খুব বেশি দিনের নয়। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জোয়ারভাটার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তড়িৎ উৎপাদনের চেষ্টা চলছে।

সৌরশক্তি
সূর্য থেকে যে শক্তি পাওয়া যায় তাকে বলা হয় সৌরশক্তি। আমরা জানি সূর্য সকল শক্তির উৎস। পৃথিবীতে যত শক্তি আছে তার সবই কোনো না কোনোভাবে সূর্য থেকে আসা বা সূর্য কিরণ ব্যবহৃত হয়েই তৈরি হয়েছে। যেমন আধুনিক সভ্যতার ধারক জীবাশ্ব জ্বালানিতে আসলে বহুদিনের সঞ্চিত সৌরশক্তি আছে।

কাজ: সৌরশক্তি থেকে তাপ শক্তি উৎপন্ন করা।
প্রয়োজনীয় উপকরণ: আতশি কাঁচ/ধাতব চাকতি
পদ্ধতি: প্রথমে একটি আতশি কাঁচ নাও। আতশী কাঁচে সাধারণত একটি উত্তল লেন্স থাকে। লেন্সের সাহায্যে সূর্যরশ্মিকে কাগজের টুকরার উপর ফোকাস কর। দেখবে যথাযথ ফোকাস করলে কাগজে আগুন জ্বলে উঠবে।

এছাড়া সৌরশক্তিকে শীতের দেশে ঘরবাড়ি গরম রাখার কাজে ব্যবহার করা হয়। শস্য, মাছ, সবজি ইত্যাদি শুকানোর কাজে সৌরশক্তি ব্যবহৃত হয়। মাছ শুকিয়ে শুটকি তৈরি করে তা বহুদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। সৌরশক্তি দ্বারা বয়লারে বাষ্প তৈরি করে তার দ্বারা তড়িৎ উৎপাদনের জন্য টার্বাইন ঘুরানো হয়। আধুনিক কৌশল ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে সৌরকোষ। সৌরকোষের বৈশিষ্ট্য হলো এর উপর সূর্যের আলো পড়লে তা থেকে সরাসরি তড়িৎ পাওয়া যায়। এছাড়া সৌরকোষের রয়েছে নানা রকমের ব্যবহার। যেমন: কৃত্রিম উপগ্রহে তড়িৎশক্তি সরবরাহের জন্য সৌরকোষ ব্যবহৃত হয়।

নবায়নযোগ্য শক্তির সুবিধা-বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

নবায়নযোগ্য শক্তির অনেক রকম সুবিধা পাওয়া যায়। বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে শক্তির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এই শক্তি এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে বায়োগ্যাস পরিচ্ছন্ন জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এটি উন্নতমানের জৈব সার পেতে সাহায্য করে। দূষণমুক্ত পরিবেশের সহায়ক হয়। স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করে। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি যেমন: পকেট ক্যালকুলেটর, পকেট রেডিও, ইলেকট্রনিক ঘড়ি, ইত্যাদি সৌরশক্তির সাহায্যে চালানো যায়। মূলত নবায়নযোগ্য শক্তির প্রধান সুবিধা হলো এটি নবায়নযোগ্য, এটি কখনো শেষ হয়ে যাবে না। নিচে এর সুবিধাসমূহ উল্লেখ করা হলো।

  • বায়ুপ্রবাহ ও সৌরশক্তি একটি অফুরন্ত শক্তির উৎস। কারণ বায়ু ও সূর্য আরো প্রায় ৫ বিলিয়ন বৎসর বিদ্যমান থাকবে।
  • পানির স্রোতকে ব্যবহার করেও শক্তির উৎপাদন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে স্রোতকে বাধা দেওয়ার জন্য তৈরি ব্রিজ বা ব্যারেজ সড়ক যোগাযোগকে উন্নত করে। চাঁদ যেহেতু পানির জোয়ার-ভাটাকে প্রভাবিত করে এবং এটি যেহেতু আরো বহুকাল বিদ্যমান থাকবে তাই পানির জোয়ার-ভাটা থেকে প্রাপ্ত শক্তি সর্বদাই ব্যবহার সম্ভব।
  • নবায়নযোগ্য শক্তি সাধারণত পরিবেশবান্ধব, কারণ এরা সাধারনত বায়ুতে কার্বন ডাইঅক্সাইড বাড়ায় না।

নবায়নযোগ্য শক্তির প্রয়োজনীয়তা যেমন আমাদের দেশে অনস্বীকার্য, তেমনি এর প্রাপ্যতাও অনেকটা সহজ। আমাদের দেশের অনেক অঞ্চল আছে যেখানে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। সেখানে আমরা সহজেই সৌরশক্তির সাহায্যে বিদ্যুৎ পেতে পারি। তাছাড়া বায়োগ্যাস উৎপাদনে রয়েছে আমাদের বিপুল সম্ভাবনা। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস সীমিত থাকায় আমাদের এই বিকল্প শক্তির সন্ধান অবশ্যই করতে হবে। প্রাকৃতিক গ্যাসকে আমাদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরবরাহ করাতে প্রচুর খরচ হয়। তবে আমরা যদি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট গড়ে তুলতে পারি সেক্ষেত্রে আমরা দ্বৈত সুবিধা পাব। প্রয়োজনীয় শক্তির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আমরা জমির চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সারের চাহিদাও মেটাতে সক্ষম হব। এছাড়া কৃষিনির্ভর এই দেশে বায়োগ্যাসের উপাদান সহজলভ্য। সুতরাং আমাদেরকে ভবিষ্যৎ চিন্তায় এখনই এই শক্তির যথাযথ ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

নবায়নযোগ্য শক্তি: সীমাবদ্ধতা

বর্তমানে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যাপক চাহিদা আছে। তবে কিছুক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারে অসুবিধা দেখা যায়। নিচে তা আলোচনা করা হলো।

  • বায়োগ্যাস প্লান্ট থেকে যে গ্যাস পাওয়া যায় তার পরিমাণ তা প্রাকৃতিক গ্যাসের কূপ থেকে প্রাপ্ত গ্যাসের তুলনায় কম।
  • বায়ুপ্রবাহ ও স্রোত থেকে যে নবায়নযোগ্য শক্তি পাওয়া যায় তার উৎস সীমিত। কারণ এর জন্য যে প্লান্ট তৈরি করতে হয়, তার জন্য সুবিধাজনক জায়গা লাগে। বায়ুর মাধ্যমে উৎপাদনের অন্যতম সমস্যা হলো সবসময় বায়ুপ্রবাহ থাকে না।
  • সূর্যের আলো থাকলে সৌরশক্তি নির্ভর নবায়নযোগ্য শক্তি পাওয়া যায় কিন্তু আকাশ মেঘলা থাকলে এর উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
  • অনেক সময় পানির জোয়ারভাটাকে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহারের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যায়। এছাড়া নদীর উপর ব্রিজ বা ব্যারেজ নির্মাণে জাহাজ চলাচলও বাধাগ্রস্ত হয়।
  • সৌর, বায়ু ও পানির স্রোত থেকে উৎপন্ন নবায়নযোগ্য শক্তি সাধারণত ব্যয়বহুল।
common.content_added_by

অনবায়নযোগ্য শক্তি (পাঠ ১০)

149
149

অনবায়নযোগ্য মানেই হলো, যে শক্তি একবার ব্যবহার করা হলে তার উৎস থেকে পুনরায় শক্তি উৎপন্ন করা যায় না। এটি হলো মূলত প্রাকৃতিক সম্পদ, যা পুনরায় উৎপন্ন করা যায় না। প্রকৃতিতে এদের তৈরি করতে যত সময় লাগে, তার চেয়ে কম সময়ে ব্যায়িত হয়। অনবায়নযোগ্য শক্তির মধ্যে অন্যতম হলো কয়লা, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, ইউরেনিয়াম, ইত্যাদি।

অনবায়নযোগ্য শক্তির সুবিধা

অনবায়নযোগ্য শক্তির সুবিধা মূলত দুটি দিক থেকে বিবেচনা করা হয়-দাম ও প্রাচুর্য। বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি বা যানবাহন অনবায়নযোগ্য শক্তির সাহায্যে চলে, এদের নবায়নযোগ্য শক্তির সাহায্যে চালাতে অনেক বেশি খরচ লাগে। যেমন: সাধারণ বা প্রাকৃতিক গ্যাস বা তেলে কম খরচে যানবাহন বা যন্ত্রপাতি চলে। অপরপক্ষে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস, যেমন সৌরশক্তি দ্বারা কোনো যানবাহন চালানো কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। অনবায়নযোগ্য জ্বালানি সস্তা, এদের অল্প পরিমাণ থেকে বেশি শক্তি পাওয়া যায়, যেমন পারমানবিক চুল্লিতে অল্প ইউরেনিয়াম থেকে অনেক বিদ্যুৎশক্তি পাওয়া যায়।

অনবায়নযোগ্য শক্তির সীমাবদ্ধতা

অনবায়নযোগ্য জ্বালানির অসুবিধাগুলো হলো-

  • এটি অনবায়নযোগ্য ও দ্রুত ফুরিয়ে যায়; এরা মূলত নিঃশেষ হয়ে যায়।
  • পরিবেশকে বেশ উচ্চমাত্রায় দূষিত করে।
  • এদের দহনে কার্বন ডাইঅক্সাইড বাতাসে ছড়ায়, ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং তৈরি করে।
common.content_added_by

শক্তির ব্যবহার ও সংকট (পাঠ ১১)

125
125

মানুষ জীবন ধারণে ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য যা কিছু করে তাতেই শক্তির প্রয়োজন হয়। দিন দিন বেড়েই চলছে শক্তির ব্যবহার, ফলে তৈরি হচ্ছে শক্তির সংকট। নিম্নোক্ত কারণগুলোর জন্য শক্তির সংকট ঘটে-

  • ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর জন্য অধিক হারে শক্তির প্রয়োজন হচ্ছে।
  • উন্নয়নশীল দেশসমূহ ব্যাপক হারে দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, কলকারখানা ইত্যাদি নির্মাণ করছে এবং যানবাহন ব্যবহার করছে। এ সকল নির্মাণ কাজে ও যানবাহন চালানো এবং রক্ষণাবেক্ষণে অধিক শক্তি ব্যয় করছে।
  • মানুষ উন্নত জীবনযাপনের জন্য বিলাসবহুল বাড়িঘর নির্মাণ করে। রেডিয়ো, টিভি, ভিসিআর, কম্পিউটার, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রপাতি অধিক হারে ব্যবহার করার ফলে শক্তির সংকট বাড়ছে।
  • মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজকর্ম ও যোগাযোগ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে অধিক শক্তি ব্যয় হচ্ছে।

উপরোক্ত কারণসমূহের পেছনে প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান দেওয়ার ব্যর্থতা বিদ্যমান যার কারণে শক্তির সংকট তৈরি হয়। তাই আমাদেরকে বিকল্প শক্তির সন্ধান করতে হচ্ছে।

common.content_added_by

শক্তির বিকল্প উৎসের সন্ধানে (পাঠ ১২)

87
87

এ যাবৎ প্রাপ্ত প্রাকৃতিক শক্তির মধ্যে তেল, গ্যাস, কয়লা, বিদ্যুৎ প্রভৃতি অবিরত ব্যবহারের ফলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। পারমাণবিক শক্তি সম্ভাবনাময় উৎস হিসেবে আবির্ভূত হলেও এর প্রারম্ভিক খরচ বেশি। শক্তি সরবরাহে রয়েছে অনিশ্চয়তা ও বিপদের ঝুঁকি।

আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাস অমূল্য সম্পদ, কিন্তু এটা নবায়নযোগ্য নয়। নবায়নযোগ্য নয় এমন কোনো শক্তির উৎসের উপর আর নির্ভর করা যায় না। আমাদের দেশের প্রায় ১৬ কোটি লোকের খাদ্য প্রস্তুতের জন্য রান্না-বান্নার কাজে বছরে প্রচুর জ্বালানি ব্যবহৃত হচ্ছে। এ সব জ্বালানির মধ্যে রয়েছে কাঠ, খড়কুটো, গোবর, প্রভৃতি পচনশীল পদার্থ। এগুলো মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির সহায়ক। কিন্তু রান্নার কাজে ব্যয় হয়ে যাওয়ায় জৈবসার হিসেবে ব্যবহার সীমিত হচ্ছে। ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। রান্নার কাজে প্রচলিত জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহার সর্বাধিক। ফলে দেশের শুধু বনজ সম্পদই ধ্বংস হচ্ছে না, আমাদের পরিবেশেও নেমে আসছে বড়ো ধরনের বিপর্যয়।

এ সকল বিষয় বিবেচনা করে এ বিরাট জ্বালানির খাতে বিকল্প উৎসের সন্ধান করা হচ্ছে অবিরত। ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীরা বায়োগ্যাস প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। সৌরশক্তিকে আংশিকভাবে হলেও কাজে লাগাতে সমর্থ হয়েছেন। সৌরশক্তি, সমুদ্রস্রোত ও বায়ুশক্তিও এক একটা উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

জৈব গ্যাস উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে পারলে সুদূর পল্লিঅঞ্চলে জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়াও বাতি ও টিভি চালানোর মতো বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। এ প্রযুক্তি গ্রহণ করলে প্রাকৃতিক বনজসম্পদের উপর চাপ কমবে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে। জমির উর্বরতা সংরক্ষণ করে অধিক ফসল ফলানো যাবে। সর্বোপরি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমরা একটা সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ রেখে যেতে পারব। সুতরাং বায়োগ্যাস প্রযুক্তি অবলম্বন, সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

common.content_added_by

আমাদের জীবনে শক্তির প্রভাব ও এর সাশ্রয়ী ব্যবহার (পাঠ ১৩)

85
85

প্রায় ষোল কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত আমাদের বাংলাদেশ। প্রতিবছর রান্নাবান্নার কাজে প্রচুর জ্বালানি ব্যবহৃত হচ্ছে। এর অধিকাংশ হলো কাঠ, খড়কুটা, নাড়া, শুকনো গোবর, ইত্যাদি। প্রচলিত জ্বালানি হিসেবে এগুলো ব্যবহারের ফলে দেশের বনজসম্পদ কমছে, মাটি উর্বরতা হারাচ্ছে এবং পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। ফলে আগামী দিনে বর্ধিত জনসংখ্যার জ্বালানি চাহিদা পূরণে আমাদেরকে হিমশিম খেতে হবে। জ্বালানি সংকট মোকাবিলার বিষয় আমাদেরকে অবশ্যই ভাবতে হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা শক্তির ব্যবহার করছি। আমাদের বাঁচার জন্য যেমন শক্তির প্রয়োজন, তেমনি জীবনমান উন্নয়নের জন্যও শক্তির প্রয়োজন। শক্তি না হলে আমাদের জীবন চলে না। তাই শক্তি আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা দেখেছি যে, জীবাশ্ম জ্বালানি আমাদের শক্তির এক বিরাট উৎস। কিন্তু এ শক্তি সীমিত এবং এক সময়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাই মানুষ শক্তির বিকল্প উৎসের সন্ধানে সচেষ্ট। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস কিছুটা সম্ভাবনাময় বলে মনে হচ্ছে। যেহেতু অফুরন্ত শক্তির কোনো উৎস পাওয়ার সম্ভাবনা নাই তাই প্রাপ্ত শক্তি ব্যবহারে আমাদের অবশ্যই সচেতন ও মিতব্যয়ী হতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে শক্তির অপব্যবহার বা অপচয় রোধ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। শক্তির সংরক্ষণ আমাদের ব্যক্তিগত খরচ কমায়। এ জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:

  • শক্তিকে ব্যক্তিগত সম্পদ না ভেবে সমষ্টিগত সম্পদ বিবেচনা করার মানসিকতা সৃষ্টি।
  • রেডিয়ো, টিভি, বাতি, শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র প্রভৃতি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করে অন্য সময় বন্ধ রাখা।
  • ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন বা যন্ত্রপাতি বেশি শক্তি ব্যয় করে। এ জন্য এ সকল সরঞ্জামাদির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও কার্যকর রাখা অপরিহার্য।
  • বিনা কারণে অথবা অপ্রয়োজনে যানবাহনের ইঞ্জিন চালু না রাখা।

নতুন শব্দ:
কাজ, ক্ষমতা ও শক্তি, সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, শক্তির রূপান্তর, নবায়নযোগ্য শক্তি, অনবায়নযোগ্য শক্তি, বায়োগ্যাস, শক্তির সংকট ও বিকল্প শক্তির উৎস।

এ অধ্যায়ে আমরা যা শিখলাম

  • কাজ করার সামর্থই হলে শক্তি।
  • আমাদের চারপাশে রয়েছে শক্তির বিভিন্ন উৎস।
  • শক্তির সৃষ্টি বা বিনাশ নেই, শক্তি কেবল এক রূপ থেকে অপর এক বা একাধিক রূপে পরিবর্তিত হতে পারে।
  • নবায়নযোগ্য শক্তির প্রয়োজনীয়তা যেমন আমাদের দেশে অনস্বীকার্য, তেমনি এর প্রাপ্যতা অনেকটা সহজ।
  • দিন দিন বেড়েই চলছে শক্তির ব্যবহার, ফলে তৈরি হচ্ছে শক্তির সংকট।
  • দৈনন্দিন জীবনে শক্তির অপব্যবহার বা অপচয় রোধ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
common.content_added_by

অনুশীলনী

183
183

শূন্যস্থান পূরণ কর।

১. কাজ করার _______ হলো শক্তি।

২. জেনারেটর মূলত _____ শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করে।

৩. বায়োগ্যাস উৎপন্ন করা যায় _________ ও ________ উপাদান থেকে।

সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন

১. ক্ষমতা ও শক্তির মধ্যে পার্থক্য কী?
২. শক্তির নিত্যতা ব্যাখ্যা কর।
৩. শক্তির সংকট সৃষ্টির কারণগুলো উল্লেখ কর।
৪. অনবায়নযোগ্য শক্তির সুবিধা কীভাবে পাওয়া যায়?

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১. কোনটি শক্তির অনবায়নযোগ্য উৎস?

ক. বায়ু
খ. পানির স্রোত
গ. সৌর শক্তি
ঘ. কয়লা

২. অতীশ কখনো কখনো রাতে লাইটযুক্ত চার্জার ফ্যানের সাহায্যে পড়ালেখা করে। এ ক্ষেত্রে সে ব্যবহার করে-
i. আলোকশক্তি
ii. বিদ্যুৎশক্তি
iii. রাসায়নিক শক্তি
নিচের কোনটি সঠিক?

ক. i ও ii
খ. ii ও iii
গ. i ও iii
ঘ. i, ii ও iii

নিচের উদ্দীপকের আলোকে ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও।

একজন ব্যায়ামবিদ ২০০ কেজির ভার উত্তোলন করেন এবং ভারটি নিচে নামান। এরপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে খাবার খেতে খেতে গান শুনতে লাগলেন।

৩. ভার উত্তোলন থেকে ভার নিচে নামানো পর্যন্ত শক্তির রূপান্তরের সঠিক ক্রম কোনটি?

৪. ভার উত্তোলকের খাদ্য গ্রহণ ও গান শোনার সাথে কোন শক্তি দুইটির সম্পর্ক রয়েছে।

ক. তাপ ও শব্দ
খ. তাপ ও বিদ্যুৎ
গ. রাসায়নিক ও শব্দ
ঘ. স্থিতি ও তাপ

সৃজনশীল প্রশ্ন

১. সামিহার গ্রামের বাড়ি বিজয়নগরে এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। তাই গ্রামবাসীর অনেকেই সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। আবার গত ঈদের ছুটিতে মামার সাথে সে কাপ্তাই বেড়াতে গিয়ে দেখে পানি থেকেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।

ক. শক্তির প্রধান উৎস কী?
খ. প্রাকৃতিক গ্যাস অনবায়নযোগ্য শক্তি কেন? ব্যাখ্যা কর।
গ. সামিহার দেখা কাপ্তাইয়ের পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের কৌশল ব্যাখ্যা কর।
ঘ. সামিহার গ্রামে উদ্দীপকে ব্যবহৃত শক্তির উপযোগিতা আলোচনা কর।

২. মুমিন সাহেব ইদানীং তাঁর হাঁস-মুরগি ও গরুর খামারের বিষ্ঠা আবর্জনা থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় এক ধরনের গ্যাস উৎপন্ন করছেন। এতে খামারের বিভিন্ন কাজে শক্তি ও গ্যাসের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত গ্যাস বিক্রি করতে পারছেন।

ক. ক্ষমতা কাকে বলে?
খ. শক্তি রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা কর।
গ. উদ্দীপকে উৎপন্ন গ্যাস কোন ধরনের শক্তির উৎস ব্যাখ্যা কর।
ঘ. শক্তি সংরক্ষণে রাশেদ সাহেবের কার্যক্রমের গুরুত্ব বিশ্লেষণ কর।

common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion