ব্লাড গ্রুপ বা রক্তের গ্রুপ (6.3.2)

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - জীববিজ্ঞান (নতুন সংস্করণ) জীবে পরিবহণ | - | NCTB BOOK
147
147

একজন আশঙ্কাজনক বা মুমূর্ষু রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন, তার রক্তের গ্রুপ 'বি' পজিটিভ। তোমরা এ রকম বিজ্ঞাপন প্রায়শই টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পাও। রক্তের গ্রুপ বা ব্লাড গ্রুপ কী? কেনইবা ব্লাড গ্রুপ জানা প্রয়োজন? অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে যে বিভিন্ন ব্যক্তির লোহিত রক্ত কণিকায় A এবং B নামক দুই ধরনের অ্যান্টিজেন (antigens) থাকে এবং রক্তরসে a ও b দুধরনের অ্যান্টিবডি (antibody) থাকে। এই অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডির উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে মানুষের রক্তকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করা যায়। একে ব্লাড গ্রুপ বলে। বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার 1901 সালে মানুষের রক্তের শ্রেণিবিন্যাস করে তা A, B, AB এবং ০- এ চারটি গ্রুপের নামকরণ করেন। সাধারণত একজন মানুষের রক্তের গ্রুপ আজীবন একই রকম থাকে।
নিচের সারণিতে রক্তের গ্রুপের অ্যান্টিবডি এবং অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি দেখানো হলো:

আমরা উপরের সারণিতে রস্তে বিভিন্ন অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডির উপস্থিতি দেখেছি। এর ভিত্তিতে আমরা ব্লাড গ্রুপকে এভাবে বর্ণনা করতে পারি। যেমন:
গ্রুপ A: এ শ্রেণির রন্দ্রে এ অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টি-B অ্যান্টিবডি (সংক্ষেপে B অ্যান্টিবডি) থাকে।
গ্রুপ B: এ শ্রেণির রন্তে ও অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টি-এ অ্যান্টিবডি (সংক্ষেপে এ অ্যান্টিবডি) থাকে।
গ্রুপ AB: এই শ্রেণির রস্তে A ও B অ্যান্টিজেন থাকে এবং কোনো অ্যান্টিবডি থাকে না।
গ্রুপ ০: এ শ্রেণির রক্তে কোনো অ্যান্টিজেন থাকে না কিন্তু a ও B অ্যান্টিবডি থাকে।
দাতার লোহিত কণিকা বা কোষের কোষঝিল্লিতে উপস্থিত অ্যান্টিজেন যদি প্রহীতার রক্তরসে উপস্থিত এমন অ্যান্টিবডির সংস্পর্শে আসে, যা উন্তু অ্যান্টিজেনের সাথে বিক্রিয়া করতে সক্ষম তাহলে, অ্যান্টিজেন- অ্যান্টিবডি বিক্রিয়া হয়ে গ্রহীতা বা রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। এজন্য সব গ্রুপের রক্ত সবাইকে দেওয়া যায় না। যেমন: তোমার রক্তের গ্রুপ যদি হয় এ (অর্থাৎ লোহিত কণিকার ঝিল্লিতে এ অ্যান্টিজেন আছে) এবং তোমার বন্ধুর রন্তের গ্রুপ যদি B হয় (অর্থাৎ রক্তরসে এ অ্যান্টিবডি আছে) তাহলে তুমি তোমার বন্ধুকে রক্ত দিতে পারবে না। যদি দাও তাহলে তোমার এ অ্যান্টিজেন তোমার বন্ধুর a অ্যান্টিবডির সাথে বিক্রিয়া করে বন্ধুকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই দাতার রস্তে যে অ্যান্টিজেন থাকে তার সাথে মিলিয়ে এমনভাবে প্রহীতা নির্বাচন করতে হয় যেন তার রক্তে দাতার অ্যান্টিজেনের সাথে সম্পর্কিত অ্যান্টিবডিটি না থাকে। এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করে কোন গ্রুপ কাকে রক্ত দিতে পারবে বা পারবে না, তার একটা ছক বানানো যায়।

চিত্র 6.12: কোন গ্রুপের রঙ কাকে দেওয়া যাবে তার ছক

উপরের সারণিটি লক্ষ করলে দেখতে পারবে ০ গ্রুপের রক্তবিশিষ্ট ব্যক্তি সব গ্রুপের রক্তের ব্যক্তিকে রক্ত দিতে পারে। এদের বলা হয় সর্বজনীন রক্তদাতা (universal donor)। AB রক্তধারী ব্যক্তি যেকোনো ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ করতে পারে। তাই তাকে সর্বজনীন রক্তগ্রহীতা (universal recipient) বলা হয়।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে সর্বজনীন রক্তদাতা কিংবা সর্বজনীন রক্তগ্রহীতার ধারণা খুব একটা প্রযোজ্য নয়। কেননা, রক্তকে অ্যান্টিজেনের ভিত্তিতে শ্রেণিকরণ করার ক্ষেত্রে ABO পদ্ধতি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলেও রক্তে আরও অসংখ্য অ্যান্টিজেন থাকে, যেগুলো ক্ষেত্রবিশেষে অসুবিধার কারণ হতে পারে। যেমন: রেসাস (Rh) ফ্যাক্টর, যা এক ধরনের অ্যান্টিজেন। কারো রক্তে এই ফ্যাক্টর উপস্থিত থাকলে তাকে বলে পজিটিভ আর না থাকলে বলে নেগেটিভ। এটি যদি না মেলে তাহলেও গ্রহীতা বা রোগী আরও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। তাই ABO গ্রুপের পাশাপাশি রেসাস ফ্যাক্টরও পরীক্ষা করে মিলিয়ে দেখা চাই। অর্থাৎ রেসাস ফ্যাক্টরকে বিবেচনায় নেওয়া হলে রক্তের গ্রুপগুলো হবে A+, A-, B+ B-, AB+, AB-, O+ এবং ০-। নেগেটিভ গ্রুপের রক্তে যেহেতু রেসাস ফ্যাক্টর অ্যান্টিজেন নেই, তাই এটি পজিটিভ গ্রুপকে দেওয়া যাবে কিন্তু পজিটিভ গ্রুপের রক্ত নেগেটিভ গ্রুপকে দেওয়া যাবে না। এছাড়া রক্তে আরও অনেকগুলো অ্যান্টিজেনভিত্তিক গৌণ গ্রুপ (minor blood group) থাকায় রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে ABO গ্রুপিং এবং Rh টাইপিং এর পাশাপাশি ক্রস ম্যাচিং (cross matching) নামক একটি পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক যাতে গৌণ গ্রুপসমূহের কারণে জটিলতার সৃষ্টি না হয়। তাছাড়া, রক্ত গ্রহীতা যেন জীবাণুঘটিত মারাত্মক রোগের (যেমন: এইডস, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি ইত্যাদি) সংক্রমণের শিকার না হয় সেটি নিশ্চিত করতে দাতার রক্তের স্ক্রিনিং পরীক্ষা (screening test) করাটাও জরুরি।


রক্তদান ও সামাজিক দায়বদ্ধতা
আঘাত, দুর্ঘটনা, শল্যচিকিৎসা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে অত্যধিক রক্তক্ষরণ হলে দেহে রক্তের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। রক্তশূন্যতা দূর করার জন্য ঐ ব্যক্তির দেহে রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন হয়। জরুরি ভিত্তিতে এই রক্তশূন্যতা দূর করার জন্য রোগীর দেহে অন্য মানুষের রক্ত দিতে হয়। অন্যকে রক্তদান করা বর্তমানে একটি সাধারণ ঘটনা। জরুরি অবস্থায় অন্য ব্যক্তির রক্ত সরাসরি বা ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে সংগ্রহ করা রক্ত রোগীর দেহে প্রবেশ করানো হয়। কোনো ব্যক্তির শিরার মধ্য দিয়ে বাইরে থেকে অন্যের রক্ত প্রবেশ করানোর প্রক্রিয়াকে রক্ত সঞ্চালন (Blood transfusion) বলে। এটি একটি চমৎকার ফলপ্রদ ব্যবস্থা, যার ফলে রোগীর প্রাণ রক্ষা হয়। তবে কোনো অবস্থাতেই রোগীর রক্তের গ্রুপ ও প্রকৃতি পরীক্ষা না করে এক রোগীর দেহে অন্য কোনো ব্যক্তির বা ব্লাড ব্যাংকে রক্ষিত রক্ত প্রবেশ করানো উচিত নয়। ব্যতিক্রম হলে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়ে রোগীর জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে বেড়ে যায়। যেমন: রক্তকণিকাগুলোর জমাট বাঁধা, বিশ্লিষ্ট হওয়া, জন্ডিসের প্রাদুর্ভাব এবং প্রস্রাবের সাথে হিমোগ্লোবিন নির্গত হওয়া ইত্যাদি।
আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজন হয়। মনে রাখতে হবে, এটি আমাদের সবার জন্য একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা। যেহেতু রক্তের কোনো বিকল্প নেই, তাই এরূপ অবস্থায় অনেক সময় প্রচুর রক্তের প্রয়োজন হয় এবং অন্যের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে ঐ জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করতে হয়। এরূপ জরুরি পরিস্থিতিতে জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়।
অন্যকে রক্তদান করা একটি মহৎ কাজ। এতে রক্তদাতার নিজের কোনো ক্ষতি হয় না। একজন সুস্থ মানুষের দেহ থেকে 450 মিলি রক্ত বের করে দিলে তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। তার দেহ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় 20 লক্ষ লোহিত রক্তকণিকা সৃষ্টি করতে পারে। দেখা গেছে, কোনো সুস্থ ব্যক্তি চার মাস পর পর রক্তদান করলে দাতার দেহে সামান্যতম কোনো অসুবিধা হয় না।
বর্তমানে রক্তদানে উদ্বুদ্ধকরণে নানা রকম কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। যেমন: কোনো বিশেষ দিবসে বা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে রক্তদান কর্মসূচির আয়োজন। এতে জনসাধারণের মাঝে রক্তদান সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ও ভীতি অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে। অতীতের তুলনায় মানুষ এখন রক্তদান এবং গ্রহণ সম্পর্কে অধিক আগ্রহী ও সচেতন।

6.4.1 হৃৎপিণ্ডের গঠন
হৃৎপিণ্ড বক্ষ গহ্বরের বাম দিকে দুই ফুসফুসের মাঝখানে অবস্থিত একটি ত্রিকোণাকার ফাঁপা অঙ্গ। এটি হৃৎপেশি নামক এক বিশেষ ধরনের অনৈচ্ছিক পেশি দিয়ে গঠিত। হৃৎপিণ্ড পেরিকার্ডিয়াম নামক পাতলা পর্দা দিয়ে আবৃত থাকে। হৃৎপিণ্ড-প্রাচীরে থাকে তিনটি স্তর, বহিঃস্তর বা এপিকার্ডিয়াম, মধ্যস্তর বা মায়োকার্ডিয়াম এবং অন্তঃস্তর বা এন্ডোকার্ডিয়াম।
বহিঃস্তর (Epicardium): এটি মূলত যোজক কলা নিয়ে গঠিত। এই স্তরটিতে বিক্ষিপ্তভাবে চর্বি থাকে এবং এটি আবরণী কলা দিয়ে আবৃত।
মধ্যস্তর (Myocardium): এটি বহিঃস্তর এবং অন্তঃস্তরের মাঝখানে অবস্থান করে। দৃঢ় অনৈচ্ছিক পেশি দিয়ে এ স্তর গঠিত।
অন্তঃস্তর (Endocardium): এটি সবচেয়ে ভিতরের স্তর। হৃৎপিন্ডের প্রকোষ্ঠগুলো অন্তঃস্তর দিয়ে
আবৃত। এই স্তরটি হৃৎপিন্ডের কপাটিকাগুলোকেও আবৃত করে রাখে। হৃৎপিন্ডের ভিতরের স্তর ফাঁপা এবং চারটি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। উপরের প্রকোষ্ঠ দুটি নিচের দুটির চেয়ে আকারে ছোট। উপরের প্রকোষ্ঠ দুটিকে ডান এবং বাম অলিন্দ (right & left atrium) বলে এবং নিচের প্রকোষ্ঠ দুটিকে ডান এবং বাম নিলয় (right & left ventricle) বলে। অলিন্দ দুটির প্রাচীর তুলনামূলকভাবে পাতলা, আর নিলয়ের প্রাচীর পুরু। অলিন্দ এবং নিলয় যথাক্রমে আন্তঃঅলিন্দ পর্দা এবং আন্তঃনিলয় পর্দা দিয়ে পরস্পর পৃথক থাকে।

common.content_added_by

common.read_more

টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion