পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য (পাঠ ৭ ও ৮)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম | - | NCTB BOOK
578
578

পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পর থেকেই দেখা যায় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ও মুক্তির বদলে বাঙালিরা পেয়েছিল বৈষম্যমূলক আচরণ। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার সম্পর্ক হয়ে যায় শোষক ও শোষিতের। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মাঝে ব্যাপক বৈষম্যের মাধ্যমে বাঙালিদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাঙালিরা বিভিন্নভাবে এই শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। সবশেষে মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।

রাজনৈতিক বৈষম্য

হাজার মাইলের ব্যবধানে গড়ে ওঠা পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে শুরুতেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাঙালিরা বৈষম্যের শিকার হয়। পাকিস্তানের জনসংখ্যার বড়ো অংশ বাঙালি হলেও ঢাকাকে রাজধানী না করে করাচিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজধানী করা হয়। রাষ্ট্রের বড়ো পদ গভর্নর জেনারেল, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার বেশিরভাগ সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নেওয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তান এক রকমের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে রাখে।

১৯৪৭-৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের ২১১জনের মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ৯৫ জন। আইয়ুব খানের আমলে ৬২ জন মন্ত্রীর মধ্যে মাত্র ২২ জন ছিলেন বাঙালি। এসব বাঙালি মন্ত্রীদের আবার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।

আইয়ুব খানের আমলে (১৯৫৮-৬৯) বাঙালি রাজনীতিবিদদের দমনে জেল, জরিমানা ছাড়াও বিভিন্ন আদেশ ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে শাসকেরা প্রাদেশিক ও জাতীয় নির্বাচনে অনীহা দেখায়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে। পূর্ব পাকিস্তানের শাসন অচল করে রাখে। ১৯৫৮ তে সামরিক শাসন জারি করে গনতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করা হয়। এমনকি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা (রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য) করে সরকার। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও তাদের সরকার গঠন করতে দেওয়া হয়নি। পরিণতিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবি 'স্বাধীনতার দাবিতে' রূপান্তরিত হয়।

প্রশাসনিক বৈষম্য

একটি নবীন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে সাধারণত সরকারি চাকরিতেই বেশির ভাগ মানুষ যোগ দিতে চায়। এতে রাষ্ট্র কোনো বৈষম্য বা বাধা সৃষ্টি করলে তা মৌলিক অধিকার হরণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হয়। সংবিধানেও প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ পেশা গ্রহণের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বাঙালিরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ন্যায্য পদ থেকে বঞ্চিত হতো। পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিজেদের লোকদের বেশি ও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়ে পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করত। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা অধিক হওয়া সত্ত্বেও সরকারি পদে বেশির ভাগ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় যেমন প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বড়ো পদে বাঙালিদের নেওয়া হতো না। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রথম শ্রেণির পদে মাত্র ২৩ ভাগ বাঙালি অফিসার ছিলেন। তাছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রেলওয়ে, কর্পোরেশনসহ সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন কার্যালয়ে বাঙালিদের নিয়োগে একইভাবে বৈষম্য করা হতো।

সামরিক ক্ষেত্রে বৈষম্য

সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীতেও বৈষম্য ছিল। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৩টি সদর দপ্তর ও সমরাস্ত্র কারখানা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সামরিক বাহিনীর অফিসার পদে মাত্র শতকরা ৫ ভাগ ছিল বাঙালি। সেনাবাহিনীতে বাঙালি ছিল মাত্র শতকরা ৪ ভাগ। নৌ ও বিমান বাহিনীতে কিছু বেশি নিয়োগ দেওয়া হলেও তা উল্লেখযোগ্য ছিল না। সামরিক বাহিনীর জন্য বাজেটের শতকরা ৬০ ভাগ বরাদ্দ হতো যার বেশির ভাগ ব্যয় করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও ছিল বৈষম্য। এ কারণে আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবিতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুরুত্বসহ বিবেচিত হয়। সরকারি অবহেলার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত অরক্ষিত থাকত। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পূর্ব-পাকিস্তানের নিরাপত্তাহীনতা প্রবলভাবে ধরা পড়ে।

অর্থনৈতিক বৈষম্য

পাকিস্তান রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় সরকার ছিল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সকল ব্যাংক, বিমা, বাণিজ্য ও শিল্প-প্রতিষ্ঠানের প্রধান অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল। পূর্ব পাকিস্তান বৈদেশিক মুদ্রা বেশি আয় করলেও শতকরা ২১ ভাগের বেশি অর্থ পূর্ব পাকিস্তানে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। বৈদেশিক সাহায্যের শতকরা ৩৪ ভাগ পূর্ব পাকিস্তান পেতো। অথচ ঋণের বোঝা বাঙালিদের বহন করতে হতো। এক্ষেত্রে বিদেশ থেকে যা আমদানি করা হতো তার মাত্র ৩১ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য কম অর্থ বরাদ্দ হওয়ায় এখানে উন্নয়ন তেমন হয়নি। অথচ আমাদের টাকায় পশ্চিম পাকিস্তানকে উন্নত করে গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচুর সম্পদ পাচার হতো। রপ্তানি আয়ের ২০০০ মিলিয়ন ডলার পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হয়েছিল। এই বৈষম্য বোঝানোর জন্যে সে সময়ে ব্যবহৃত একটি প্রতীকী পোস্টার উপস্থাপন করা হলো।

গরুটি পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ঘাস খাচ্ছে আর দুধ দোহন করে নিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। অর্থাৎ উৎপাদন হয় পূর্ব পাকিস্তানে আর অর্থ চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে।

সাংস্কৃতিক বৈষম্য

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ধ্বংস করতে পাকিস্তানি শাসকরা তৎপর হয়ে উঠে। ১৯৪৭ থেকেই জোরপূর্বক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাতে শুরু করে তারা। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাঙালিকে জীবন দিতে হয়। ১৯৫৬ সালে সংবিধানে বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হলেও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে চক্রান্ত থেমে থাকে নি। এ সময় পূর্ব বাংলার নাম পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। উর্দু হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। চলচ্চিত্র, নাটক, পত্রিকা, বই প্রকাশে সীমাহীন নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও রেডিয়ো-টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত সম্প্রচার বন্ধ এবং বাংলা নববর্ষ উদযাপন নিষিদ্ধ করা হয়। এভাবে বাঙালির সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বিভিন্নভাবে আঘাত হানা হয়।

বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া

বাঙালি লড়াকু জাতি। মুঘল, ব্রিটিশ আমলে বাঙালি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণও বাঙালি জাতি কখনো মুখ বুজে সহ্য করেনি। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালিরা পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে পরাজিত করে। এতে বাঙালি প্রথম বারের মতো স্বল্প সময়ের জন্য সরকার গঠনের সুযোগ পায়। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্ররা শিক্ষা-আন্দোলনের মাধ্যমে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু করে। ষাটের দশকে সাহিত্য সম্মেলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে আইয়ুববিরোধী তৎপরতা চালানো হয়। ১৯৬১ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটে। একই বছর 'ছায়ানট' নামের সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হলে বাঙালির সংগীত চর্চা ও বিভিন্ন উৎসব পালনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। পুরো ঘাটের দশক জুড়ে চলে সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের আন্দোলন। ১৯৬৬ সালে ছয় দফার দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে বৈষম্য দূরীকরণসহ বাঙালি নিজেদের দেশ চালানোর পরিকল্পনা পেশ করে। বাঙালির এই দাবি সরকার প্রত্যাখ্যান করলে শুরু হয় ছয় ও এগার দফাভিত্তিক আন্দোলন।

গণআন্দোলনের চাপে ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা (রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য) প্রত্যাহার করে আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আওয়ামী লীগের এই নিরঙ্কুশ বিজয়েই মূলত স্বাধীনতার লক্ষ্যে এগিয়ে যায় বাঙালি। পাকিস্তান ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা ষড়যন্ত্র ও কালক্ষেপণ করতে থাকে, শুরু করে নানা টালবাহানা।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্য রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, চালায় হত্যাযজ্ঞ। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক রাজারবাগ পুলিশ লাইনস আক্রান্ত হলে পুলিশ লাইনস বেইজ হতে আক্রমণের সংবাদ তার বার্তার মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করা হয় ঐ রাতেই। ২৬ মার্চ তারিখে মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর তিনি ২৭শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আবারও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর জনযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের ২৪ বছরের শোষণ আর বৈষম্যের অবসান ঘটে। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

কাজ-১: তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিরা যেসব ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল তার তালিকা কর।
কাজ- ২: সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যের তুলনামূলক চিত্র দেখাও।
কাজ-৩: পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত কর।
কাজ-৪: পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিপীড়ন ও বৈষম্যের ফলাফল কী হলো- তার ধারণা দাও।
common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion