পরাগায়নকে পরাগ সংযোগও বলা হয়। পরাগায়ন ফুল এবং বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়ার পূর্বশর্ত। ফুলের পরাগধানী থেকে পরাগরেণুর একই ফুলে অথবা একই জাতের অন্য ফুলের গর্ভমুন্ডে স্থানান্তরিত হওয়াকে পরাগায়ন বলে। পরাগায়ন দুধরনের, স্ব-পরাগায়ন এবং পর-পরাগায়ন।
(a) স্ব-পরাগায়ন: একই ফুলে বা একই গাছের ভিন্ন দুটি ফুলের মধ্যে যখন পরাগায়ন ঘটে, তখন তাকে স্ব-পরাগায়ন বলে। সরিষা, ধুতুরা ইত্যাদি উদ্ভিদে স্ব-পরাগায়ন ঘটে থাকে।
স্ব-পরাগায়নের ফলে পরাগরেণুর অপচয় কম হয়, পরাগায়নের জন্য বাহকের উপর নির্ভর করতে হয় না এবং পরাগায়ন নিশ্চিত হয়। এর ফলে নতুন যে উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়, তাতে বৈশিষ্ট্যেরও কোনো পরিবর্তন আসে না এবং কোনো একটি প্রজাতির চরিত্রপত বিশুদ্ধতা বজায় থাকে। তবে এতে জিনগত বৈচিত্র্য কম থাকে। এই বীজের থেকে জন্ম নেওয়া নতুন গাছের অভিযোজন ক্ষমতা কমে যায় এবং অচিরেই প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে।
(b) পর-পরাগায়ন: একই প্রজাতির দুটি ভিন্ন উদ্ভিদের ফুলের মধ্যে যখন পরাগ সংযোগ ঘটে, তখন তাকে পর-পরাগায়ন বলে। শিমুল, পেঁপে ইত্যাদি গাছের ফুলে পর-পরাগায়ন হতে দেখা যায়।
পর-পরাগায়নের ফলে নতুন চরিত্রের সৃষ্টি হয়, বীজের অংকুরোদগমের হার বৃদ্ধি পায়, বীজ অধিক জীবনীশক্তিসম্পন্ন হয় এবং নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়। দুটি ভিন্ন পুণসম্পন্ন গাছের মধ্যে পরাগায়ন ঘটে, তাই এর ফলে যে বীজ উৎপন্ন হয় তা নতুন গুণসম্পন্ন হয় এবং বীজ থেকে যে গাছ জন্মায় তাও নতুন পুণসম্পন্ন হয়। এ কারণে এসব গাছে নতুন বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়। তবে এটি বাহকনির্ভর প্রক্রিয়া হওয়ায় পরাগায়নের নিশ্চয়তা থাকে না, এতে প্রচুর পরাগরেণুর অপচয় ঘটে। কলে প্রজাতির বিশুদ্ধতা নষ্ট হওযার সম্ভাবনা থাকে।
পরাগায়নের মাধ্যম
পরাগ স্থানান্তরের কাজটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো না কোনো মাধ্যমের দ্বারা হয়ে থাকে। যে মাধ্যম পরাপ বহন করে গর্ভমুণ্ড পর্যন্ত নিয়ে যায়, তাকে পরাগায়নের মাধ্যম বলে। বায়ু, পানি, কীট-পতঙ্গ, পাখি, বাদুড়, শামুক এমনকি মানুষ এ ধরনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে থাকে। মধু খেতে অথবা সুন্দর রঙের আকর্ষণে পতঙ্গ বা প্রাণী ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায়। এ সময়ে ঐ ফুলের পরাগরেণু বাহকের গায়ে লেগে যায়। এই বাহকটি যখন অন্য স্কুলে গিয়ে বসে তখন পরাগ পরবর্তী ফুলের গর্ভমুন্ডে লেগে যায়। এভাবে পরাগায়ন ঘটে। পরাগায়নের মাধ্যমগুলোর সাহায্য পেতে ফুলের পঠনে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।
পতঙ্গ পরাগী ফুল বড়, রঙিন ও মধুগ্রন্থিযুক্ত এবং পরাগরেণু ও গর্ভমুণ্ড আঠালো ও সুগন্ধযুক্ত হয়, যেমন: জবা, কুমড়া, সরিষা ইত্যাদি।
বায়ুপরাগী ফুল হালকা এবং মধুপ্রন্থিহীন। এসব ফুলে সুগন্ধ নেই। এরা সহজেই বাতাসে ভেসে যেতে পারে। এদের গর্ভমুন্ড আঠালো এবং শাখান্বিত, কখনো পালকের মতো। ফলে বাতাস থেকে পরাগরেণু সহজেই সংগ্রহ করে নিতে পারে, যেমন: ধান। পানিপরাগী ফুল আকারে ক্ষুদ্র এবং হালকা। এরা সহজেই পানিতে ভাসতে পারে। এসব ফুলে সুপদ্ধ নেই। স্ত্রীপুষ্পের বৃদ্ধ লম্বা কিন্তু পুংপুষ্পের বৃষ্ণ ছোট। পরিণত পুংপুষ্প বৃত্ত থেকে খুলে পানিতে ভাসতে থাকে এবং স্ত্রী পুষ্পের কাছে পৌঁছালে সেখানেই পরাগায়ন ঘটে, যেমন: পাতাশেওলা।
প্রাণীপরাগী ফুল মোটামুটি বড় ধরনের হয়, তবে ছোট হলে ফুলগুলো পুষ্পমঞ্জরিতে সাজানো থাকে। এদের রং আকর্ষণীয় হয়। এসব ফুলে গন্ধ থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে, যেমন: কদম, শিমুল, কচু ইতাদি।
পুং গ্যামেটোফাইটের উৎপত্তি (Microsporogenesis)
পরাগরেণু পুং-গ্যামেটোফাইটের প্রথম কোষ। পরাগ মাতৃকোষটি (2n) মিয়োসিস বিভাজনের মাধ্যমে চারটি অপত্য পরাগ কোষ (n) সৃষ্টি করে। পূর্ণতাপ্রাপ্তির পরপর পরাগথলিতে থাকা অবস্থায়ই পরাগরেপুর অঙ্কুরোদগম শুরু হয়। পরাগরেণুর নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্রিকাটি মাইটোটিক পদ্মতিতে বিভাজিত হয়। এ বিভাজনে একটি বড় কোষ এবং একটি ক্ষুদ্র কোষ সৃষ্টি হয়। বড়কোষটিকে নালিকোষ (Tube cell) এবং ছোট কোষটিকে জেনারেটিভ কোষ (Generative Cell) বলে।
নালিকোষ বড় হয়ে পরাগনালি (Polen tube) এবং জেনারেটিভ কোষটি বিভাজিত হয়ে দুটি পুংজনন কোষ (Male gametes) উৎপন্ন করে। জেনারেটিভ কোষের এ বিভাজন পরাগরেণুতে অথবা পরাগনালিতে সংঘটিত হতে পারে।
স্ত্রী-গ্যামেটোফাইটের উৎপত্তি (Megasporogenesis)
ভ্রূণপোষক কলায় (Nucellus tissue) ডিম্বকরপ্তের কাছাকাছি একটি কোষ আকারে সামান্য বড় হয়। এর প্রোটোপ্লাজম ঘন এবং নিউক্লিয়াসটি তুলনামূলকভাবে বড়। এ কোষটি বিয়োজন বিভাজনের (Meiosis) মাধ্যমে চারটি হ্যাপ্লয়েড (n) কোষ সৃষ্টি করে। সর্বনিম্ন কোষটি ছাড়া বাকি তিনটি কোষ বিনষ্ট হয়ে যায়। সর্বনিম্ন এই বড় কোষটি বৃদ্ধি পেয়ে ক্রমশ ভূণথলিতে পরিণত হয়। এ কোষটির নিউক্লিয়াস হ্যাপ্লয়েড (n)। এই নিউক্লিয়াসটি বিভক্ত হয়ে দুটি নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। এ নিউক্লিয়াস দুটি ভ্রুণথলির দুই মেরুতে অবস্থান নেয়। এবার এ দুটি নিউক্লিয়াসের প্রতিটি পরপর দুবার বিভন্ত হয়ে চারটি করে নিউক্লিয়াস সৃষ্টি করে।
এর পরবর্তী ধাপে দুই মেরু থেকে একটি করে নিউক্লিয়াস ভ্রুণথলির কেন্দ্রস্থলে এসে পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে ডিপ্লয়েড (2n) গৌণ নিউক্লিয়াস (Secondary nucleus) সৃষ্টি করে। দুই মেরুর নিউক্লিয়াসগুলো সামান্য সাইটোপ্লাজম সহকারে কোষের সৃষ্টি করে। ডিম্বকরশ্নের দিকের কোষ তিনটিকে গর্ভযন্ত্র(Egg apparatus) বলে। এর মাঝের কোষটি বড়। একে ডিম্বাণু (Egg) এবং অন্য কোষকে সহকারী কোষ (Synergids) বলা হয়।গর্ভযন্ত্রের বিপরীত দিকের কোষ তিনটিকে প্রতিপাদ কোষ (Antipodal cells) বলে। এভাবেই ভ্রূণথলির গঠনপ্রক্রিয়া শেষ হয়।
common.read_more