নবায়নযোগ্য শক্তি (পাঠ ৭-৯)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান শক্তির ব্যবহার | - | NCTB BOOK
87
87

আমরা বিভিন্ন শক্তির উৎস থেকে শক্তি পাই। এসব শক্তির উৎস দু'ধরনের: নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য। নবায়নযোগ্য নাম থেকে তোমরা সহজেই বুঝতে পারবে এর অর্থ কী বুঝায়। যা কিছু নবায়ন করা যায়। এক্ষেত্রে কোনো জিনিস ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করে পুনরায় ঐ জিনিসটি দ্বারা আবার শক্তি উৎপাদন করা যায়। অর্থাৎ যে শক্তির উৎসকে বারবার ব্যবহার করা যায় সেই শক্তিকে বলা হয় নবায়নযোগ্য শক্তি। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সূর্যরশ্মি, বায়োগ্যাস, পানি, বায়ুপ্রবাহ, পানির জোয়ারভাটা, ইত্যাদি।
নিম্নে আমরা বায়োগ্যাস, সৌরশক্তি, পানির জোয়ারভাটা এবং বায়ুপ্রবাহ হতে নবায়নযোগ্য শক্তির উপাদান সম্পর্কে ধারণা লাভ করব।

বায়োগ্যাস (উদ্ভিজ ও প্রাণীজ)
গরু, ছাগল, ঘোড়া ও মহিষের বিষ্ঠা জ্বালানি হিসেবে বহু প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রাণীর এসব বিষ্ঠা শক্তির এক প্রকার উৎস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শুকনো গোবর পুড়িয়ে তাপশক্তি উৎপন্ন করা হয়। বায়োগ্যাসে যে সকল উপাদান বা বর্জ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো গরু, শূকর এবং মুরগি হতে প্রাপ্ত বর্জ্য, শস্য, পরিত্যক্ত উদ্ভিদ, ইত্যাদি। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র প্রাণিজ বা কেবলমাত্র উদ্ভিদজ উপকরণ অথবা উভয় প্রকারের মিশ্রণও ব্যবহার করতে পার। শূকর বা মুরগি রাখার জায়গা থেকে মলমিশ্রিত যে কাঁচা খড় পাওয়া যায়, সেগুলো বয়োগ্যাস তৈরির উপযুক্ত কাঁচামাল এবং এটি প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ উপকরণের ভালো মিশ্রণ। তবে এগুলো ব্যবহারের সময় ছোটো ছোটো টুকরা করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে আরম্ভ করার সময় ব্যবহারের আগে শুকনো উদ্ভিজ্জ উপকরণগুলো খুব ছোট ছোট করে কেটে অথবা পিষে খোসা বের করে নিতে হয়। আর টাটকা উদ্ভিজ্জগুলো অন্তত দশদিন বাইরে পচতে দিতে হবে।

বায়ুপ্রবাহ

আদিম মানুষ ভয় পেত বায়ুপ্রবাহ। সভ্যতার বিকাশ ও বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ফলে এই বায়ুপ্রবাহকে মানুষ বর্তমানে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছে। আদিম মানুষ চার-পাঁচটা পাখার সাহায্যে চক্র বানিয়ে বাতাসের সাহায্যে চক্র ঘুরাত। চক্রের ঘূর্ণন কাজে লাগিয়ে মানুষ কুয়া থেকে পানি তোলা, কৃষিসেচ, যব অথবা গম ভাঙ্গানো, আখ মাড়াই, ধানকাটা, খড় কাটা ইত্যাদি কাজ করত। পরে মানুষ বাতাসকে কাজে লাগিয়ে কাঠ চেরাইয়ের মতো কঠিন কাজও সম্পন্ন করেছে। পৃথিবীর বহু অঞ্চলের মানুষ আগে এ ধরনের কাজে বড়ো বড়ো চক্রাকার এক ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করত। যা বর্তমানে বায়ুকল বা উইন্ডমিল নামে পরিচিত। উইন্ডমিল চালিয়ে বহুদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।

পানির জোয়ার-ভাটা
নদী বা সমুদ্রের পানির জোয়ার-ভাটার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন যন্ত্র চালনার ব্যাপারটি অনেক দিন আগেই উদ্ভাবিত হয়েছে। কিন্তু জোয়ারভাটার শক্তিকে তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তরের ব্যাপারটি খুব বেশি দিনের নয়। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জোয়ারভাটার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তড়িৎ উৎপাদনের চেষ্টা চলছে।

সৌরশক্তি
সূর্য থেকে যে শক্তি পাওয়া যায় তাকে বলা হয় সৌরশক্তি। আমরা জানি সূর্য সকল শক্তির উৎস। পৃথিবীতে যত শক্তি আছে তার সবই কোনো না কোনোভাবে সূর্য থেকে আসা বা সূর্য কিরণ ব্যবহৃত হয়েই তৈরি হয়েছে। যেমন আধুনিক সভ্যতার ধারক জীবাশ্ব জ্বালানিতে আসলে বহুদিনের সঞ্চিত সৌরশক্তি আছে।

কাজ: সৌরশক্তি থেকে তাপ শক্তি উৎপন্ন করা।
প্রয়োজনীয় উপকরণ: আতশি কাঁচ/ধাতব চাকতি
পদ্ধতি: প্রথমে একটি আতশি কাঁচ নাও। আতশী কাঁচে সাধারণত একটি উত্তল লেন্স থাকে। লেন্সের সাহায্যে সূর্যরশ্মিকে কাগজের টুকরার উপর ফোকাস কর। দেখবে যথাযথ ফোকাস করলে কাগজে আগুন জ্বলে উঠবে।

এছাড়া সৌরশক্তিকে শীতের দেশে ঘরবাড়ি গরম রাখার কাজে ব্যবহার করা হয়। শস্য, মাছ, সবজি ইত্যাদি শুকানোর কাজে সৌরশক্তি ব্যবহৃত হয়। মাছ শুকিয়ে শুটকি তৈরি করে তা বহুদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। সৌরশক্তি দ্বারা বয়লারে বাষ্প তৈরি করে তার দ্বারা তড়িৎ উৎপাদনের জন্য টার্বাইন ঘুরানো হয়। আধুনিক কৌশল ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে সৌরকোষ। সৌরকোষের বৈশিষ্ট্য হলো এর উপর সূর্যের আলো পড়লে তা থেকে সরাসরি তড়িৎ পাওয়া যায়। এছাড়া সৌরকোষের রয়েছে নানা রকমের ব্যবহার। যেমন: কৃত্রিম উপগ্রহে তড়িৎশক্তি সরবরাহের জন্য সৌরকোষ ব্যবহৃত হয়।

নবায়নযোগ্য শক্তির সুবিধা-বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

নবায়নযোগ্য শক্তির অনেক রকম সুবিধা পাওয়া যায়। বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে শক্তির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এই শক্তি এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে বায়োগ্যাস পরিচ্ছন্ন জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এটি উন্নতমানের জৈব সার পেতে সাহায্য করে। দূষণমুক্ত পরিবেশের সহায়ক হয়। স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করে। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি যেমন: পকেট ক্যালকুলেটর, পকেট রেডিও, ইলেকট্রনিক ঘড়ি, ইত্যাদি সৌরশক্তির সাহায্যে চালানো যায়। মূলত নবায়নযোগ্য শক্তির প্রধান সুবিধা হলো এটি নবায়নযোগ্য, এটি কখনো শেষ হয়ে যাবে না। নিচে এর সুবিধাসমূহ উল্লেখ করা হলো।

  • বায়ুপ্রবাহ ও সৌরশক্তি একটি অফুরন্ত শক্তির উৎস। কারণ বায়ু ও সূর্য আরো প্রায় ৫ বিলিয়ন বৎসর বিদ্যমান থাকবে।
  • পানির স্রোতকে ব্যবহার করেও শক্তির উৎপাদন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে স্রোতকে বাধা দেওয়ার জন্য তৈরি ব্রিজ বা ব্যারেজ সড়ক যোগাযোগকে উন্নত করে। চাঁদ যেহেতু পানির জোয়ার-ভাটাকে প্রভাবিত করে এবং এটি যেহেতু আরো বহুকাল বিদ্যমান থাকবে তাই পানির জোয়ার-ভাটা থেকে প্রাপ্ত শক্তি সর্বদাই ব্যবহার সম্ভব।
  • নবায়নযোগ্য শক্তি সাধারণত পরিবেশবান্ধব, কারণ এরা সাধারনত বায়ুতে কার্বন ডাইঅক্সাইড বাড়ায় না।

নবায়নযোগ্য শক্তির প্রয়োজনীয়তা যেমন আমাদের দেশে অনস্বীকার্য, তেমনি এর প্রাপ্যতাও অনেকটা সহজ। আমাদের দেশের অনেক অঞ্চল আছে যেখানে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। সেখানে আমরা সহজেই সৌরশক্তির সাহায্যে বিদ্যুৎ পেতে পারি। তাছাড়া বায়োগ্যাস উৎপাদনে রয়েছে আমাদের বিপুল সম্ভাবনা। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস সীমিত থাকায় আমাদের এই বিকল্প শক্তির সন্ধান অবশ্যই করতে হবে। প্রাকৃতিক গ্যাসকে আমাদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরবরাহ করাতে প্রচুর খরচ হয়। তবে আমরা যদি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট গড়ে তুলতে পারি সেক্ষেত্রে আমরা দ্বৈত সুবিধা পাব। প্রয়োজনীয় শক্তির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আমরা জমির চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সারের চাহিদাও মেটাতে সক্ষম হব। এছাড়া কৃষিনির্ভর এই দেশে বায়োগ্যাসের উপাদান সহজলভ্য। সুতরাং আমাদেরকে ভবিষ্যৎ চিন্তায় এখনই এই শক্তির যথাযথ ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

নবায়নযোগ্য শক্তি: সীমাবদ্ধতা

বর্তমানে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যাপক চাহিদা আছে। তবে কিছুক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারে অসুবিধা দেখা যায়। নিচে তা আলোচনা করা হলো।

  • বায়োগ্যাস প্লান্ট থেকে যে গ্যাস পাওয়া যায় তার পরিমাণ তা প্রাকৃতিক গ্যাসের কূপ থেকে প্রাপ্ত গ্যাসের তুলনায় কম।
  • বায়ুপ্রবাহ ও স্রোত থেকে যে নবায়নযোগ্য শক্তি পাওয়া যায় তার উৎস সীমিত। কারণ এর জন্য যে প্লান্ট তৈরি করতে হয়, তার জন্য সুবিধাজনক জায়গা লাগে। বায়ুর মাধ্যমে উৎপাদনের অন্যতম সমস্যা হলো সবসময় বায়ুপ্রবাহ থাকে না।
  • সূর্যের আলো থাকলে সৌরশক্তি নির্ভর নবায়নযোগ্য শক্তি পাওয়া যায় কিন্তু আকাশ মেঘলা থাকলে এর উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
  • অনেক সময় পানির জোয়ারভাটাকে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহারের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যায়। এছাড়া নদীর উপর ব্রিজ বা ব্যারেজ নির্মাণে জাহাজ চলাচলও বাধাগ্রস্ত হয়।
  • সৌর, বায়ু ও পানির স্রোত থেকে উৎপন্ন নবায়নযোগ্য শক্তি সাধারণত ব্যয়বহুল।
common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion