খাদ্য পরিপাক ক্রিয়া (Digestion of Food) (5.8.3)

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - জীববিজ্ঞান (নতুন সংস্করণ) খাদ্য, পুষ্টি এবং পরিপাক | - | NCTB BOOK
167
167

যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মানুষের পৌষ্টিক নালির অভ্যন্তরে জটিল, অদ্রবণীয়, অশোষণযোগ্য খাদ্য উপাদানগুলো নির্দিষ্ট উৎসেচক বা এনজাইম এবং প্রাণরস বা হরমোনের উপস্থিতিতে বিশ্লেষিত হয়ে শোষণযোগ্য এবং দ্রবণীয় সরল উপাদানে পরিণত হয়, তাকে পরিপাক বলে। এ প্রক্রিয়ায় খাদ্য প্রথমত সরল দ্রবণীয় অবস্থায় রূপান্তরিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে কোষ আবরণীর ভিতর দিয়ে অতি সহজে কোষের ভিতরে প্রবেশ করে। সবশেষে রক্ত এই পরিপাককৃত সরল উপাদানগুলোকে দেহের বিভিন্ন অংশে সরবরাহ করে।

(a) মুখে পরিপাক
মুখগহ্বরে দাঁত ও জিহ্বার সাহায্যে খাদ্য চিবানোর ফলে খাদ্যবস্তু ছোট ছোট টুকরোয় পরিণত হয়। এ সময় লালাগ্রন্থি থেকে লালা নিঃসৃত হয়ে খাদ্যের সাথে মিশে যায়। লালা খাদ্যবস্তুকে গলাধঃকরণে সাহায্য করে। লালায় টায়ালিন বা স্যালাইভারি অ্যামাইলেজ নামক উৎসেচক বা এনজাইম থাকে। এটি শ্বেতসারকে মলটোজে পরিণত করে। মুখগহ্বরে আমিষ বা স্নেহজাতীয় খাদ্যের কোনোরূপ পরিবর্তন হয় না।
মুখগহ্বর থেকে খাদ্যদ্রব্য পেরিস্টালসিস (Peristalsis) প্রক্রিয়ায় অন্ননালির মধ্য দিয়ে পাকস্থলীতে প্রবেশ করে। পৌষ্টিক নালিগাত্রের পেশির পর্যায়ক্রমিক সংকোচন ও প্রসারণের ফলে খাদ্যদ্রব্য সামনের দিকে অগ্রসর হয়। অন্ননালিতে খাদ্যের কোনো পরিপাক ঘটে না।
(b) পাকস্থলীতে পরিপাক
পাকস্থলীতে খাদ্য আসার পর অন্তঃপ্রাচীরের গ্যাস্ট্রিকগ্রন্থি থেকে গ্যাস্ট্রিক রস ক্ষরিত হয়। এই রসে প্রধান যে উপাদানগুলো থাকে তা হলো:
হাইড্রোক্লোরিক এসিড: হাইড্রোক্লোরিক এসিড খাদ্যের মধ্যে কোনো অনিষ্টকারী ব্যাকটেরিয়া থাকলে তা মেরে ফেলে, নিষ্ক্রিয় পেপসিনোজেনকে সক্রিয় পেপসিনে পরিণত করে এবং পাকস্থলীতে পেপসিনের সুষ্ঠু কাজের জন্য অম্লীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে।
HCL নিষ্ক্রিয় পেপসিনোজেন → সক্রিয় পেপসিন
পেপসিন (Pepsin): এক ধরনের এনজাইম, যা আমিষকে ভেঙে দুই বা ততোধিক অ্যামাইনো এসিড দিয়ে তৈরি যৌগ গঠন করে, যা পলি পেপটাইড নামে পরিচিত।
পেপসিন আমিষ → পলিপেপটাইড
শর্করা এবং স্নেহজাতীয় খাদ্য সাধারণত পাকস্থলীতে পরিপাক হয় না। কারণ এদের পরিপাকের জন্য গ্যাস্ট্রিক রসে নির্দিষ্ট কোনো এনজাইম থাকে না।
পাকস্থলীতে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছানো মাত্র উপরোক্ত রসগুলো নিঃসৃত হয়। পাকস্থলীর অনবরত সংকোচন ও প্রসারণ এবং এনজাইমের ক্রিয়ার ফলে খাদ্য মিশ্র মন্ডে পরিণত হয়। একে পাকমণ্ড বা কাইম (chyme) বলে। এই মণ্ড অনেকটা স্যুপের মতো এবং কপাটিকা ভেদ করে ক্ষুদ্রান্ত্রে প্রবেশ করে।
(c) ক্ষুদ্রান্ত্রে পরিপাক
পাকস্থলী থেকে পাকমন্ড ক্ষুদ্রান্ত্রের ডিওডেনামে প্রবেশ করে। এ সময় অগ্ন্যাশয় থেকে একটি ক্ষারীয় পাচকরস ডিওডেনামে আসে। এই পাচকরস খাদ্যমণ্ডের অম্লভাব প্রশমিত করে। পাচকরসের এনজাইম দিয়ে শর্করা এবং আমিষ পরিপাকের কাজ চলতে থাকে এবং স্নেহপদার্থের পরিপাক শুরু হয়।
যকৃৎ থেকে পিত্তরস নিঃসৃত হয়। এটি অম্লীয় অবস্থায় খাদ্যকে ক্ষারীয় করে পরিপাকের উপযোগী করে তোলে। পিত্ত-লবণ স্নেহপদার্থের ক্ষুদ্র কণাগুলোকে পানির সাথে মিশতে সাহায্যে করে। পিত্ত-লবণ পিত্তরসের অন্যতম উপাদান। লাইপেজ নামক এনজাইমের কাজ যথাযথ সম্পাদনের জন্য পিত্ত-লবণের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ লবণের সংস্পর্শে স্নেহপদার্থ সাবানের ফেনার মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানায় পরিণত হয়। স্নেহবিশ্লেষক লাইপেজ এই দানাগুলোকে ভেঙে ফ্যাটি এসিড এবং গ্লিসারলে পরিণত করে।

অগ্ন্যাশয় রসে অ্যামাইলেজ, লাইপেজ ও ট্রিপসিন নামক এনজাইম থাকে। আগ্রিক রসে আত্মিক অ্যামাইলেজ, লাইপেজ, মলটেজ, ল্যাকটেজ ও সুক্রেজ ইত্যাদি এনজাইম থাকে। আংশিক পরিপাককৃত আমিষ ক্ষুদ্রান্ত্রে ট্রিপসিনের সাহায্যে ভেঙে অ্যামাইনো এসিড এবং সরল পেপটাইডে পরিণত হয়।
ট্রিপসিন
পলিপেপটাইড → অ্যামাইনো এসিড সরল পেপটাইড
অ্যামাইলেজ শ্বেতসারকে সরল শর্করায় পরিণত করে।
অ্যামাইলেজ
শ্বেতসার গ্লুকোজ
পরিপাককৃত খাদ্য শোষণ: ক্ষুদ্রান্ত্রে সব ধরনের খাদ্যই সম্পূর্ণভাবে নির্দিষ্ট এনজাইমের ক্রিয়ায় পরিপাক হয়ে সরল, শোষণযোগ্য খাদ্য উপাদানে পরিবর্তিত হয়। ক্ষুদ্রান্ত্রের অন্তঃপ্রাচীরে অবস্থিত রক্তজালকসমৃদ্ধ আঙ্গুলের মতো প্রক্ষেপিত অংশ থাকে। একে ভিলাই বলে, আর একবচনে বলে ভিলাস। প্রতিটি ভিলাসের মাঝখানে ল্যাকটিয়াল নামক লসিকা-জালক রক্তের কৈশিক নালি দিয়ে পরিবেষ্টিত থাকে। ভিলাই ভাঁজে ভাঁজে থাকায় ইলিয়ামের প্রাচীরগাত্রের আয়তন বৃদ্ধি পায় এবং ব্যাপকভাবে পরিপাককার্য চলা সম্ভব হয়।
এসব রক্তনালি যুক্ত হয়ে হেপাটিক শিরা গঠন করে। এই শিরা দিয়ে শোষিত রক্ত যকৃতে আসে। স্নেহপদার্থের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা ভিলাসের ল্যাকটিয়ালে শোষিত হওয়ার পর প্রথমে লসিকা দিয়ে বাহিত হয়ে রন্তস্রোতে মিশে। কোষে অনুপ্রবেশের পর পিত্ত-লবণ ফ্যাটি এসিড থেকে পুনরায় পৃথক হয়ে যায়। কৈশিক নালির মধ্যে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার সময় নালির প্রাচীর ছুঁয়ে জলীয় পদার্থ বের হয়। এই জলীয় পদার্থকে লসিকা বলে। লসিকা খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে কোষে পৌঁছে দেয় এবং দূষিত পদার্থ সংগ্রহ করে রক্তস্রোতে ফিরে আসে। শোষণের পর পাকমণ্ডের অবশিষ্টাংশ কোলনে পৌঁছে।
(d) বৃহদন্ত্রে পরিপাক
কোলনে পাকমণ্ডের কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া বা পরিপাক ঘটে না। তবে খাদ্যের অসার অংশের সাথে যে পানি থাকে, তা এখানে শোষিত হয়। তাছাড়া থাকে কিছু আমিষ, লিপিড, লবণ এবং উদ্বৃত্ত এনজাইম। এসব বস্তু থেকে বৃহদন্ত্র লবণ ও পানি শোষণ করে রক্তে স্থানান্তরিত করে। ফলে উচ্ছিষ্ট খাদ্য ঘনীভূত হয়ে মলে পরিণত হয়। এই মল মলাশয়ে জমা থাকে এবং প্রয়োজনমতো পায়ুপথ দিয়ে বের হয়ে আসে।
আত্তীকরণ: শোষিত খাদ্যবস্তুর প্রোটোপ্লাজমে পরিণত বা রূপান্তরিত করার পদ্ধতি হলো আত্তীকরণ। এটা একটি গঠনমূলক বা উপচিতি প্রক্রিয়া। কোষের প্রোটোপ্লাজম নিঃসৃত এনজাইমের সহযোগিতায় সরল খাদ্য জটিল উপাদানে পরিণত হয়। যেমন অ্যামাইনো এসিড, গ্লুকোজ, ফ্যাটি এসিড এবং গ্লিসারল রক্তের সাহায্যে দেহের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং এসব স্থানে প্রোটোপ্লাজম নিঃসৃত এনজাইমের প্রভাবে আমিষ, স্নেহ এবং শর্করা তৈরি হয়। এভাবে প্রোটোপ্লাজম কোষের ক্ষয়পূরণ ও গঠনে সহায়তা করে এবং তার ফলে দেহের বৃদ্ধি ঘটে।

common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion