দেশের ভিতরে যখন মানুষ এক স্থান হতে অন্য স্থানে গমন করে তখন তাকে অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর বলা হয়। তবে বাজার করা, অফিস করা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করাকে অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর বলা যায় না। অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর নানাভাবে ঘটে থাকে। আন্তঃআঞ্চলিক স্থানান্তর অর্থাৎ একই অঞ্চলের মধ্যে স্থানান্তর। তাছাড়া গ্রাম থেকে গ্রামে, গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে গ্রামে এবং শহর থেকে শহরে স্থানান্তর। অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যেই মূলত অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর হয়ে থাকে।
অভ্যন্তরীণ স্থানান্তরের জন্য তেমন কোনো আইন বা অনুমতির প্রয়োজন হয় না। এ ধরনের স্থানান্তর ঘটে আমাদের প্রয়োজন ও ইচ্ছা অনুযায়ী।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার চাপে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ক্রমে কমে যাচ্ছে। অনেকে ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে। বেকার ও অর্ধবেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ আর্থিক সংকট গ্রামের অনেক মানুষকে শহরে কাজের সন্ধানে আসতে বাধ্য করছে। নদীভাঙন এলাকার মানুষ বাঁচার তাগিদে গ্রাম থেকে শহরে ভীড় করছে। দারিদ্র্য, অভাব অনটন ও অন্যান্য সমস্যার কারণেও গ্রামবাসীর একটি অংশকে শহরের দিকে ধাবিত করছে। গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো শহরের উন্নত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা। গ্রামের সক্ষম ও ধনী কৃষক পরিবার তাদের সন্তানকে উন্নত শিক্ষার জন্য শহরে পাঠায়। তাছাড়া চিকিৎসা সুবিধা গ্রহণের জন্যও শহরে স্থানান্তর হয়। গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরের আরও যেসব কারণ তাহলো শহরে বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, কর্মসংস্থানের সুযোগ, বিনিয়োগ ও ব্যবসাবাণিজ্যের সুযোগ সুবিধা প্রভৃতি। তবে কিছু লোক স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয় এদেশের ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। আমাদের দেশে মানুষের গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরের কারণ হলো শিল্প কারখানাগুলো সাধারণত শহরে অবস্থিত। যেমন পোশাক শিল্প ও চামড়াশিল্পের অধিকাংশই শহরে অবস্থিত। এ কারণে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজের জন্য শহরের বস্তি এলাকায় গাদাগাদি করে বসবাস করছে। পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগ সুবিধার জন্যও মানুষ স্থানান্তরিত হয়।
অভ্যন্তরীণ স্থানান্তরের ফলাফল
বাংলাদেশের জনসংখ্যার অভ্যন্তরীণ স্থানান্তরের সুফল ও কুফল উভয়ই রয়েছে। বাংলাদেশে গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি অংশ রিকশা, গাড়ি, ভ্যানচালক বা শিল্পশ্রমিক হিসেবে নিজেদেরকে নিয়োজিত করছে। তাছাড়া তারা বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কাজে আত্মনিয়োগ করছে। অন্যদিকে বড়ো কৃষক ও মাঝারি কৃষক পরিবারের সদস্যরা স্থানান্তরিত হয়ে চাকরি, ব্যবসাবাণিজ্য বা নানা ধরনের উৎপাদনমুখী কাজে নিজেদের নিয়োজিত করছে। শহরের স্থানান্তরিত সদস্য তাদের আয় গ্রামে বসবাসকারী সদস্যদের নিকট প্রেরণ করছে। এই অর্থে মাসিক ভরণপোষণের পরে সঞ্চিত অর্থ কৃষি উৎপাদন খাতে এবং অকৃষি খাতে বিনিয়োগ করছে।
অভ্যন্তরীণ স্থানান্তরের কারণে সবচেয়ে বেশি উপকার হয়েছে গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের। এসব নারীরা কর্মহীন থাকার কারণে পরিবারের সদস্যরা তাদেরকে বোঝা মনে করতো। ফলে বৈষম্য, বঞ্চনা, প্রতারণা এবং নিপীড়ন তাদের ভাগ্যে জুটত। আজ শুধু পোশাকশিল্পেই বিপুলসংখ্যক নারীশ্রমিক কর্মরত। এখন তাদের পারিবারিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বেড়েছে। তাদের উপার্জিত অর্থে সন্তানরা লেখাপড়া করছে। উন্নত জীবনযাত্রার কিছুটা হলেও ভোগ করছে।
অভ্যন্তরীণ স্থানান্তরের ফলে আবার স্বল্প আয়ের দরিদ্র মানুষের জন্য বস্তি সৃষ্টি হয়েছে। বস্তি সুস্থ নগরজীবনের জন্য সহায়ক নয়। অপরাধ প্রবণতা, চোরাচালান, অপহরণ, মাদক, নারী ও শিশু পাচারসহ, নানা সামাজিক সমস্যা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে এই বস্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরের কারণে শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে। এতে শহরে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চাহিদা ও দাম বেড়ে যাচ্ছে। শহর থেকে গ্রামে স্থানান্তরের প্রভাব আমাদের দেশে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, আধুনিক শিক্ষিত ব্যক্তি গ্রাম উন্নয়নমূলক কাজ করার জন্য গ্রামে এসে রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ করেন। এতে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতি হয়।
গ্রাম থেকে গ্রামে স্থানান্তরের কারণে গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থার পারস্পরিক সম্পর্ক বাড়ে। একজনের বিপদে একই গ্রামের কিংবা অন্য গ্রামের লোকেরা এগিয়ে আসে। এতে পারস্পরিক সম্পর্ক বাড়ে।
শহর থেকে শহরে ও গ্রামে স্থানান্তরের ফলে মানুষের মধ্যে কর্ম দক্ষতা বাড়ে। এতে সামাজিক রীতিনীতি ও সাংস্কৃতিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়। শহর হতে গ্রাম ও শহরে স্থানান্তর মানুষের আয় ও সঞ্চয়কেও প্রভাবিত করে। কারণ অনেক সময় বিনিয়োগের কারণে জনসংখ্যার স্থানান্তর হয়। এর ফলে কর্মসংস্থান বাড়ে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রভাব ফেলে।
common.read_more