ইতোমধ্যে তোমরা পৃথিবীর আহ্নিক গতি বা নিজ অক্ষের উপর আবর্তন সম্পর্কে জেনেছ। পৃথিবীর অন্য গতিটি হচ্ছে বার্ষিক গতি। পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রায় ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা সময়ে একবার ঘুরে আসে। এই সময়কে এক সৌর বছর বা এক বছর বলা হয়। পৃথিবীর বার্ষিক গতির ফলে দিনরাত ছোটো বা বড়ো হয় এবং ঋতুর পরিবর্তন হয়।
তোমরা কী বছরের সবসময় একই রকমের আবহাওয়া দেখতে পাও? জানুয়ারি মাসে বা পৌষ-মাঘ মাসে শীত না গরম থাকে? আষাঢ় বা ভাদ্র মাসে আবহাওয়া কি পৌষ মাসের মতোই, না ভিন্ন? আমরা দেখি বাংলাদেশে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম আবহাওয়া থাকে। পৌষ বা মাঘ মাসে বেশ শীত পড়ে আবার বৈশাখ বা জ্যৈষ্ঠ মাসে বেশ গরম পড়ে। কেন, তা ভাবো তো? এইসব প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে কীভাবে ঘোরে তা জানলে।
পৃথিবী সূর্যের চারপাশে কিছুটা হেলে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। তবে পৃথিবী বছরের বিভিন্ন সময়ে তার হেলানো অবস্থান পরিবর্তন করে। তাই পৃথিবীর একটা নির্দিষ্ট অংশ একটি নির্দিষ্ট সময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট অংশ যখন সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে, তখন সেই অংশটি বেশিক্ষণ ধরে এবং খাড়াভাবে সূর্যের তাপ পায়। পৃথিবীর সেই অংশে তখন গ্রীষ্মকাল। তোমরা হয়ত জানো যে, পৃথিবীর বিষুবরেখার দুই পার্শ্বকে দুটি গোলার্ধে ভাগ করা হয়। উত্তর অংশকে উত্তর গোলার্ধ এবং দক্ষিণ অংশকে দক্ষিণ গোলার্ধ বলা হয়। আমরা উত্তর গোলার্ধে বাস করি। ২১ জুন তারিখে বাংলাদেশ সূর্যের কিছুটা কাছে চলে আসে। তাই এসময়ে আমরা সূর্যকে আমাদের মাথার উপর দেখতে পাই। এই সময়ে আমরা সবচেয়ে লম্বা দিন ও ছোটো রাত দেখতে পাই। খাড়াভাবে এবং লম্বা সময় সূর্যের তাপ পাওয়ার কারণে এই সময়টিতে এবং এর কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশে বেশ গরম পড়ে। তবে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে এই সময়ে বাংলাদেশে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে আমরা এই সময়টিকে বর্ষাকাল বলে থাকি।
২১ জুন পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ সূর্য থেকে দূরে অবস্থান করে। তাই দক্ষিণ গোলার্ধে তখন রাত বড়ো হয়, দিন ছোটো হয় এবং ওখানে সূর্যের তাপ তির্যক বা হেলানোভাবে পড়ে। ফলে দক্ষিণ গোলার্ধ এ সময় সূর্যের তাপ কম পায়। ওখানে তখন শীতকাল। যেমন অস্ট্রেলিয়ায় জুন, জুলাই ও আগস্ট এই তিন মাস শীতকাল।
পৃথিবী ২১ জুনের পরে তার হেলানো অবস্থান পরিবর্তন করতে থাকে। বাংলাদেশসহ উত্তর গোলার্ধ কিছুটা দূরে সরে যেতে থাকে, একই সাথে দক্ষিণ গোলার্ধ কিছুটা সূর্যের দিকে এগোতে থাকে। এইভাবে সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখে পৃথিবীর বিষুব অঞ্চল সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে এবং উত্তর ও দক্ষিণ মেরু ঐ সময়ে সূর্য থেকে সমান দূরত্বে থাকে। সেপ্টেম্বর ২৩ তারিখে তাই পৃথিবীর উভয় গোলার্ধে দিনরাত সমান হয়। বিষুবীয় অঞ্চলে তখন সূর্য মাথার উপরে অবস্থান করে খাড়াভাবে কিরণ দেয়, তখন বিষুবীয় অঞ্চলে বেশ গরম পড়ে। বাংলাদেশে তখন দিনরাত সমান বলে তখন শীতও নয় আবার খুব গরমও নয়। দক্ষিণ গোলার্ধেও তখন শীত চলে গিয়ে গ্রীষ্মকাল আসতে থাকে, অর্থাৎ সেখানে তখন বসন্ত।
২২ ডিসেম্বর দক্ষিণ গোলার্ধের একটি অংশ সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। আর তখন বাংলাদেশ সূর্য থেকে দূরে অবস্থান করে। তাই তখন বাংলাদেশে দিন ছোট হয় এবং রাত বড় হয়। সূর্যকে দেখা যায় দক্ষিণ দিকে হেলে কিরণ দিতে। কম সময় এবং তির্যকভাবে কিরণ পায় বলে বাংলাদেশে তখন শীত পড়ে। পক্ষান্তরে, দক্ষিণ গোলার্ধের অস্ট্রেলিয়ায় তখন দিন বড়ো এবং রাত ছোটো হয়। সূর্য তখন দক্ষিণ গোলার্ধে খাড়াভাবে কিরণ দেয়। তাই দক্ষিণ গোলার্ধে তখন গ্রীষ্মকাল।
আবার পৃথিবী ২১ মার্চ সূর্যের দিকে মুখ করে হেলে থাকে। তখন আবার পৃথিবীর সকল স্থানে দিনরাত সমান হয়। এজন্য এই সময়ে আমাদের দেশেও দিনরাত সমান হয়। এই সময়ে শীতও বেশি থাকে না আবার গরমও বেশি পড়ে না। এই সময়ে আমাদের দেশে বসন্তকাল। ২১ মার্চের পরে পৃথিবী আবার ঘুরতে ঘুরতে ২১ জুন তারিখে আগের বছরের অবস্থানে ফিরে আসে। এভাবে সূর্যের দিকে পৃথিবীর অবস্থানের তারতম্যের কারণে দিনরাত ছোটো বা বড়ো হয় এবং ঋতু পরিবর্তিত হয়।
চিত্র: ১২.৭: সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘূর্ণন
পৃথিবী যদি সূর্যের চারদিকে না ঘুরতো তাহলে কী হতো ভাবো তো? পৃথিবী সূর্যের চারদিকে না ঘুরলে পৃথিবীর কোনো একটি জায়গায় সবসময় একটি ঋতুই থাকত। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে সারা বছর হয়ত গরম থাকত। কোনো শীত আসত না। উল্টোটাও হতে পারত। অর্থাৎ সবসময় শীত থাকত। বাংলাদেশে বিভিন্ন ঋতু আছে বলে বিভিন্ন ফসল ফলে। একটি ঋতু থাকলে এক রকম ফসলই হতো। আমাদের জীবন ধারণ কষ্টকর হয়ে যেত।
রাশিয়া বা অন্যান্য শীতপ্রধান দেশে ঋতু পরিবর্তন না হলে মানুষ বাঁচতেই পারত না। সেখানে বছরের বেশির ভাগ সময় বরফ ঢাকা থাকে। সেসময় ফসল ফলে না। অল্প সময় গ্রীষ্মকাল এলে বরফ গলে যায়। মানুষ তখন ফসল ফলায়। গ্রীষ্মকাল না এলে মানুষ ফসল ফলাতে পারত না।
এ অধ্যায়ে আমরা যা শিখলাম
common.read_more