পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই শাসকদের ষড়যন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। আত্মরক্ষা ও আত্মবিকাশের প্রশ্নে নানা মতের মানুষ এক হতে থাকে। ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগ যেন ষড়যন্ত্র আর শোষণের প্রতীক হয়ে ওঠে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাজিত করে বাঙালি অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ মিলে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৪ সালে একটি জোট গঠন করেন। এ জোটই যুক্তফ্রন্ট নামে পরিচিত। এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টে যোগ দেয় আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম, গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফতে রব্বানী পার্টি। যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচন ও পূর্ববাংলার মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৯৫৪ সালের নির্বাচন পাকিস্তানের দুই অংশের পার্লামেন্ট বা সংসদ নিয়ে গঠিত জাতীয় পরিষদের কোনো নির্বাচন ছিল না। এটি ছিল শুধু পূর্ববাংলার আইন পরিষদের নির্বাচন।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ নেতৃত্বের কার্যকলাপ ও পাকিস্তানি শোষণ প্রতিরোধে এ নির্বাচন ছিল একটি মাইলফলক। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগসহ মোট ১৬টি দল এ নির্বাচনে অংশ নেয়। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় যুক্তফ্রন্ট ও মুসলিম লীগের মধ্যে। যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন বাংলার তিন প্রবীণ নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
যুক্তফ্রন্ট জনগণের সামনে তাদের ২১ দফা কর্মসূচি প্রকাশ করে। এতে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি, জমিদারি প্রথা বাতিল, পাটশিল্প জাতীয়করণ, সমবায়ভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা, মাতৃভাষার মাধ্যমে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাদান ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হয়। এছাড়া সমস্ত অন্যায় আইনকানুন বাতিল, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহিদ স্মরণে শহিদ মিনার নির্মাণ, ২১শে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা এবং পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের কথাও বলা হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের জন্যে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবিও এতে ছিল।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলমান ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা আসন ছিল, আলাদা ভোট হয়। পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদ নির্বাচনে ৩০৯টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২৩৬টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অপরদিকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের চরম বিপর্যয় ঘটে-দলটি মাত্র ৯টি আসন পায়। বাকি আসনে স্বতন্ত্রপ্রার্থীসহ অন্যান্য দল বিজয়ী হয়। যুক্তফ্রন্টের এ বিজয়কে দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকা 'ব্যালট বিপ্লব' বলে আখ্যায়িত করে।
এ নির্বাচন ছিল পূর্ববাংলার প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রথম সর্বজনীন নির্বাচন। বাঙালি নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য উজ্জীবিত হয়ে যুক্তফ্রন্টে ভোট দেয়। শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষকে যে ধোঁকা দেওয়া যায় না মুসলিম লীগের ফলাফল বিপর্যয়ে তা প্রমাণিত হয়। ভাষা ও সংস্কৃতি বিরোধী অবস্থান নিয়ে কঠোর দমননীতি ও স্বৈরশাসন চালিয়ে কোনো সরকার যে টিকে থাকতে পারে না তাও প্রমাণিত হয়। বাঙালির নতুন এ জাতীয়তাবাদী চেতনা পরবর্তীকালে সকল আন্দোলন ও নির্বাচনে প্রেরণা জুগিয়েছে। অন্যদিকে মুসলিম লীগ একটি গণবিরোধী দল হিসেবে পরিচিত হয়। ১৯৫৭ সালের মধ্যে দলটি বহুধা বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়।
স্বাধীনতার পর থেকে মুসলিম লীগের ভূমিকা বাঙালিকে ক্ষুব্ধ করেছিল। আর ভাষা আন্দোলনের বিজয়ের ফলে দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্যে তাদের আকাঙ্ক্ষা বেগবান হয়ে ওঠে। যুক্তফ্রন্টে বিভিন্ন দল ও মতের মানুষ একত্রিত হয়েছিল, এটি যুক্তফ্রন্টের সহজ বিজয়ের অন্যতম কারণ। এ জোটের কর্মসূচিতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। বাংলাভাষার মর্যাদা দান, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রসহ সকল শ্রেণির মানুষের কথা এতে ছিল। ২১ দফা কর্মসূচিও তাদের সহজ বিজয়ের আরেকটি কারণ। যুক্তফ্রন্টে প্রবীণ ও তরুণ নেতাকর্মীদের সমন্বয় ঘটে। পাশাপাশি তরুণদের প্রচার অভিযান ছিল চোখে পড়ার মতো। মুসলিম লীগের দুঃশাসন, দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতি, শোষণ, দলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি, পাকিস্তানের দুই অংশের বৈষম্য ইত্যাদি ছিল মুসলিম লীগের পরাজয়ের কারণ।
কাজ-১: যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার মূল দাবিগুলো লিখ। কাজ-২: পৃথক পৃথক ছকে মুসলিম লীগের পরাজয় ও যুক্তফ্রন্টের জয়ের কারণগুলো তালিকা তৈরি কর। |
বাঙালির অর্জন
স্বাধীনতার পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র কখনও থেমে থাকেনি। তা বরাবর অব্যাহত ছিল। দুই মাসের মাথায় বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়া হয়। এরপরে পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী বেসামরিক সরকার গঠন করা হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি দেখিয়ে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর দেশে সামরিক আইন জারি করেন। কিছুদিন পর জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ছিল এবং তখন অনেক রাজনৈতিক নেতাকে কারাগারে বন্দি করা হয়। এই রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের জন্য বাঙালি ছাত্ররা এগিয়ে আসেন। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান একটি সংবিধান রচনা করে। এই সংবিধানে বাঙালির গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ক্ষুণ্ণ হওয়ায় ছাত্ররা আন্দোলন গড়ে তোলে। তবে ছাত্রদের আন্দোলন অনেক বেশি জোরালো রূপ পায় সরকার শিক্ষানীতি ঘোষণার পর। শরিফ কমিশন নামে পরিচিত এই শিক্ষানীতিতে বাংলার বদলে পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য উর্দুভাষা চালু করা, অবৈতনিক শিক্ষা বাতিল করা এবং উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ কমিয়ে দেওয়ার বিধান যোগ করা হয়েছিল। ছাত্রদের তীব্র আন্দোলনের ফলে শেষ পর্যন্ত সরকার শরিফ কমিশন প্রণীত শিক্ষানীতি বাতিল করতে বাধ্য হয়।
common.read_more