গ্রাম ও শহর দুটোই রয়েছে বাংলাদেশে। এক সময় বাংলাদেশকে বলা হতো একটি বড়ো গ্রাম। তখন এ দেশের অর্থনীতির প্রধান উৎস ছিল কৃষি। গ্রামের কৃষকরা তাদের জমিতে নানা ফসল ফলাতো। কালের পরিক্রমায় এ দেশে শহর গড়ে উঠলেও তাতে গ্রামের প্রভাবই থেকে গিয়েছিল। পরে এক পর্যায়ে পরিবর্তন আসতে থাকে। গড়ে উঠতে থাকে বড়ো বড়ো শহর। জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। শিল্পায়নের ফলে তৈরি হয় নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান। উৎপাদন হতে থাকে হরেক রকম পণ্য সামগ্রী। শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে এসে অনেকে শহরে বসবাস শুরু করে। শহরকে কেন্দ্র করে শুরু হয় ব্যবসা বাণিজ্য। চাকরির সুবাদে গ্রাম থেকে শহরে আসে অনেকে। এভাবে গ্রামের মানুষের চেয়ে শহরে বাস করা মানুষের জীবনযাত্রা অনেকটা আলাদা হয়ে যায়। তবে একে অপরের সংস্কৃতি থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি।
বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতি
মানুষ যা করে, যা ভাবে, যা কিছু সে ব্যবহার করে এমন সকল কিছুই তার সংস্কৃতি। কাজেই গ্রামের মানুষ যে নানা ধরনের পেশার সাথে যুক্ত থাকে, ফলে সে যে আচরণ করে, যা সৃষ্টি করে বা যে ভূমিকা রাখে তার একত্রিত রূপই গ্রামীণ সংস্কৃতি। যে সব পেশাজীবী গ্রামে বাস করে তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে কৃষক, জেলে, তাঁতি, কামার, কুমার, মাঝি, দর্জি, কবিরাজ, ডাক্তার, ওঝা, বৈদ্য, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত প্রভৃতি। এদের সবার সংস্কৃতিই গ্রামীণ সংস্কৃতি।
বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের সংস্কৃতিকে আমরা দুইভাগে বিশ্লেষণ করতে পারি। ক. সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনভিত্তিক এবং খ. উৎসব ও বিনোদনভিত্তিক।
ক. সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনভিত্তিক
গ্রামীণ জীবন প্রধানত কৃষির সাথে জড়িত। কোনো কোনো মানুষের নিজের জমি আছে। জমির উৎপাদিত ফসলে তারা জীবন নির্বাহ করে। আবার যাদের জমি নেই তারা অন্যের জমিতে কাজ করে জীবনযাপন করে। তাদের জীবন কৃষির সাথে জড়িয়ে আছে। আগে কৃষক লাঙল গরু দিয়ে জমি চাষ করত। নিজে জমিতে সেচ দিত। এখন লাঙল গরুর পাশাপাশি অনেক জায়গায় ট্রাক্টর বা কলের লাঙল দিয়ে কৃষক জমি চাষ করছে। জল সেচ করছে শ্যালো বা ডিপ মেশিন দিয়ে। এসব করতে গিয়ে শহুরে জীবনের সাথে তাদের অনেকের যোগাযোগ হচ্ছে। ধীরে ধীরে গ্রামে শহুরে সংস্কৃতির প্রভাব পড়ছে।
'মাছ ভাতে বাঙালি' কথাটা কিছুকাল আগেও গ্রামের মানুষের জন্য প্রযোজ্য ছিল। কৃষকের গোলায় থাকত ধান। শ্রমের বিনিময়ে মজুরেরাও তার ভাগ পেতো। নদী নালা খাল বিলে থাকত প্রচুর মাছ। জাল ফেলে মাছ সংগ্রহ করা যেত। এখন অনেক নদী নালা ভরাট হয়ে গেছে। জমিতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার বেশি ব্যবহার করায় এসবের নির্যাস পানিতে পড়ছে। এর প্রভাবে ছোটো ছোটো মাছ আর মাছের ডিম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই আগের মতো গ্রামে মাছ সহজলভ্য নয়। তবুও গ্রামের মানুষ সাধ্যমতো মাছ, ভাত, শাকসবজি, ডাল ইত্যাদি খায়। নানা ধরনের পিঠাপুলি তৈরি হয়। গ্রামের অনেকে শাকসবজি ফলিয়ে নিজেদের খাবারের চাহিদা মিটিয়েও বিক্রি করে থাকে।
একসময় গ্রামের মানুষ সাধারণ পোশাক পরতেন। পুরুষেরা লুঙ্গি পরে খালি গায়ে অথবা গেঞ্জি বা ফতুয়া পরে কৃষিকাজ করতেন। কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে তারা পাজামা পাঞ্জাবি বা জামা পরতেন। মেয়েরা সাধারণত সুতির শাড়ি পরত। এখন কিছুটা শহুরে প্রভাব পড়েছে। কিশোর তরুণ ছেলেরা লুঙ্গি-শার্টের পাশাপাশি প্যান্ট শার্ট পরছে। মেয়েরা ফ্রক, সালোয়ার কামিজ আর শাড়ি পরছে।
আগে অঞ্চল ভেদে গ্রামের মানুষ মাটির ঘর, বাঁশ, কাঠ ও ছনের ছাউনি দেওয়া ঘরে বসবাস করত। এখন এসব ঘরের পাশাপাশি টিনের দোচালা, চৌচালা ঘর এবং ইটের দালানও তৈরি হচ্ছে।
গ্রামের মানুষ এক সময় পায়ে হেঁটেই চলাফেরা করত। কোনো কোনো অঞ্চলে গরুর গাড়ির ব্যবহার ছিল। বর্ষায় যাতায়াতের বাহন ছিল নৌকা। এখন রাস্তাঘাটের উন্নতি হওয়ায় রিক্সা ও মোটর গাড়িতে চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বৈঠা বাওয়া নৌকার বদলে এখন অনেক ক্ষেত্রে ইঞ্জিন চালিত নৌকা ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার বেশিরভাগ মুসলমান। এরপরেই হিন্দু ধর্মের মানুষের অবস্থান। সংখ্যায় কম হলেও এদেশে বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে। গ্রামীণ জীবনে সকলেই শান্তিপূর্ণভাবে যার যার ধর্ম পালন করে থাকে।
খ. উৎসব ও বিনোদনভিত্তিক
গ্রামের মানুষ যুগ যুগ ধরে নানা ধরনের আনন্দ উৎসব উদ্যাপন করে থাকে। এর কোনোটি সকল ধর্মের মানুষ মিলে মিশে করে আবার কোনোটি নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষের নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব।
বৈশাখী মেলা, নবান্ন উৎসব, ব্যবসায়ীদের হালখাতা উৎসব, নৌকাবাইচ, বিয়ে অনুষ্ঠান প্রভৃতি সকল ধর্মের মানুষ একসাথে উদযাপন করে থাকে। আগে গ্রামে বিনোদনের উল্লেখযোগ্য বিষয় হিসেবে রাতভর যাত্রা, পালাগান, কবিগানের আসর বসতো। এখন এসব হারিয়ে না গেলেও পরিবেশনা অনেক কমে গেছে।
মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা। এছাড়া শবেবরাত, ঈদ-এ-মিলাদুননবী এবং ওয়াজ মাহফিলেও কিছুটা উৎসবের আমে থাকে।
হিন্দু ধর্মের মানুষ নানা পূজা উৎসব উদযাপন করে। যেমন- দুর্গা পূজা, লক্ষ্মী পূজা, কালী পূজা, সরস্বতী পূজা, দোল পূর্ণিমা, রাস ও রথযাত্রা উৎসব ইত্যাদি। পূজা ছাড়াও আরও অনেক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান থাকে হিন্দু সমাজে।
বৌদ্ধ ধর্মের মানুষ বুদ্ধপূর্ণিমাসহ নানা ধর্মীয় উৎসব পালন করে। খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ও ক্রিসমাস ডে বা বড়দিনসহ আরো অনেক ধর্মীয় উৎসব পালন করে।
বাংলাদেশের শহুরে সংস্কৃতি
বাংলাদেশের শহুরে জীবনের সংস্কৃতিকেও আমরা দুইভাগে ভাগ করতে পারি। ক. সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনভিত্তিক এবং খ. উৎসব ও বিনোদনভিত্তিক।
ক. সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনভিত্তিক
শহরের সংস্কৃতি অনেক দিক থেকে গ্রামের চেয়ে কিছুটা পৃথক। গ্রামের সকল মানুষ একে অন্যের খবর রাখে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারা একত্রিত হয়। এ কারণে গ্রামীণ জীবনে সামাজিক বন্ধন বেশ অটুট। এদিক থেকে শহরবাসীর সামাজিক জীবনের গন্ডি বেশ ছোটো। একই দালানে থেকেও প্রতিবেশীদের সাথে তেমন যোগাযোগ থাকে না। শহরের শিশুরা যার যার বাড়িতে বা ফ্ল্যাটে একা একা বড়ো হয়। শহরে খোলা মাঠ পাওয়া কঠিন। তাই শহরের শিশুদের খেলাধুলা ও ছুটাছুটি করা অনেক সময় সম্ভব হয় না।
শহরের মানুষ যার যার পেশা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। চাকরি, শিক্ষকতা, ডাক্তারি, ব্যবসা, শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ইত্যাদি শহরের মানুষের পেশা। আজকাল বড়ো বড়ো শহরে পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে। গ্রামের অনেক পুরুষ মহিলা এসব কারখানায় কাজ নিয়ে শহরে চলে আসে। গ্রাম থেকে আসা অনেকে ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ি ও রিক্সা চালায়। মুটে মজুর হয়েও অনেকে জীবিকা অর্জন করে থাকে। তাদের কাছ থেকে গ্রামীণ সংস্কৃতির কোনো কোনো বিষয় শহরে সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলছে। একইভাবে শহুরে সংস্কৃতির অনেক কিছু প্রভাব ফেলছে গ্রামীণ সংস্কৃতিতেও।
ভাত, মাছ, মাংস খেলেও শহুরে মানুষের খাবারে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। শহরের মানুষের অনেকেই ফাস্ট ফুডের দোকানে যায়। তাদের অনেকের কাছেই স্যান্ডউইচ, বার্গার ইত্যাদি প্রিয়। শহুরে মানুষের পোশাক পরিচ্ছদে অনেক বৈচিত্র্য ও চাকচিক্য রয়েছে।
খ. উৎসব ও বিনোদনভিত্তিক
শহরে বাস করা বিভিন্ন ধর্মের মানুষ গ্রামের মানুষের মতই ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করে। এর বাইরে কোনো কোনো উৎসব শহরে কিছুটা ভিন্নভাবে পালিত হয়। শহরে পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন অনেক বেশি জাঁকজমকের সাথে পালন করা হয়। একুশের বইমেলাও এখন উৎসবের মতো উদযাপন করা হয়। টেলিভিশন ও সিনেমার পাশাপাশি মঞ্চনাটক দেখাও শহরের মানুষের জন্য একটি অন্যতম বিনোদন।
কাজ-১: গ্রামীণ জীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতিগুলো চিহ্নিত কর। কাজ-২: গ্রামীণ ও শহরে উৎসব ও বিনোদন সংস্কৃতির তুলনা কর। |
common.read_more