যে বিক্রিয়ায় কোনো পদার্থের অনেকগুলো ক্ষুদ্র অণু পরস্পর যুক্ত হয়ে বৃহৎ অণু গঠন করে সেই বিক্রিয়াকে পলিমারকরণ বিক্রিয়া (Polymerization Reaction) বলে। পলিমারকরণ বিক্রিয়ায় যে ছোট অণুগুলো অংশগ্রহণ করে তাদের প্রত্যেকটিকে এক একটি মনোমার বলে এবং বিক্রিয়ার ফলে যে বৃহৎ অণু গঠিত হয় তাকে পলিমার অণু বলে। দুইটি মনোমার একসাথে যুক্ত হলে তাকে বলে ডাইমার (dimer), তিনটি মনোমার একসাথে যুক্ত হয়ে হয় ট্রাইমার (trimer)। এভাবে অনেকগুলো মনোমার এক সাথে যুক্ত হয়ে পলিমারের সৃষ্টি হয়। আমাদের খাদ্যের একটি প্রধান উপাদান প্রোটিন। এই প্রোটিনও অ্যামাইনো এসিডের একটি পলিমার।
পলিমারকে বিভিন্নভাবে শ্রেণিবিভাগ করা যেতে পারে। তবে গঠন প্রকৃতি অনুযায়ী পলিমার দুই প্রকার, যথা: সংযোজন বা যুত পলিমার এবং ঘনীভবন পলিমার।
সংযোজন বা যুত পলিমার (Addition Polymer)
যে পলিমারকরণ বিক্রিয়ায় মনোমার অণুগুলো সরাসরি একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে দীর্ঘ শিকলবিশিষ্ট পলিমার গঠন করে তাকে সংযোজন পলিমারকরণ বিক্রিয়া বলা হয়। সংযোজন পলিমারকরণ বিক্রিয়ায় গঠিত পলিমারকে সংযোজন পলিমার বলে।
সংযোজন পলিমারকরণ বিক্রিয়া : সামান্য পরিমাণ অক্সিজেনের উপস্থিতিতে 1000 বায়ুমণ্ডল চাপে ও 200°C তাপমাত্রায় ইথিনকে উত্তপ্ত করলে পলিথিন উৎপন্ন হয়। এই বিক্রিয়াকে সংযোজন পলিমারকরণ বিক্রিয়া বলে। এই বিক্রিয়ায় ইথিনকে মনোমার বলা হয়।
পলিপ্রোপিন (Polypropene): প্রোপিনকে টাইটানিয়াম ক্লোরাইডের উপস্থিতিতে 140 atm চাপে 120°C তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করলে পলিপ্রোপিন উৎপন্ন হয়।
পলিপ্রোপিন পলিথিনের চেয়ে শক্ত ও হালকা। পলিপ্রোপিন দিয়ে দড়ি, পাইপ, কার্পেট প্রভৃতি তৈরি করা যায়।
পলিভিনাইল ক্লোরাইড বা পিভিসি (PVC): ভিনাইল ক্লোরাইডকে জৈব পার-অক্সাইডের উপস্থিতিতে উচ্চ চাপ এবং উচ্চ তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করলে পলিভিনাইল ক্লোরাইড বা পিভিসি উৎপন্ন হয়।
ঘনীভবন পলিমার (Condensation Polymer )
যে পলিমারকরণ বিক্রিয়ায় মনোমার অণুসমূহ পরস্পরের সাথে যুক্ত হবার সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু যেমন : H2O, CO2 ইত্যাদি অপসারণ করে সেই পলিমারকরণ বিক্রিয়াকে ঘনীভবন পলিমারকরণ বিক্রিয়া বলা হয়। ঘনীভবন পলিমারকরণ বিক্রিয়ায় নাইলন 6 : 6 পলিমার তৈরি হয়।
নাইলন 6:6 উৎপাদন: টাইটানিয়াম অক্সাইড এর উপস্থিতিতে হেক্সামিথিলিন ডাই-অ্যামিন এর সাথে অ্যাডিপিক এসিড উত্তপ্ত করলে নাইলন- 6 : 6 উৎপন্ন হয়। উৎসের উপর ভিত্তি করে পলিমারকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়: প্রাকৃতিক পলিমার এবং কৃত্রিম পলিমার বা প্লাস্টিক।
প্রাকৃতিক পলিমার
প্রাকৃতিকভাবে অনেক পলিমার উৎপন্ন হয়। যেমন, উদ্ভিদের সেলুলোজ ও স্টার্চ দুটোই প্রাকৃতিক পলিমার, যা বহুসংখ্যক গ্লুকোজ অণু থেকে তৈরি হয়। প্রোটিন অ্যামাইনো এসিডের পলিমার। রাবার গাছের কষ একটি প্রাকৃতিক পলিমার। আমাদের দেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট ও টাঙ্গাইল জেলায় রাবার চাষ হচ্ছে। প্রাকৃতিক রাবারের চেয়ে বহুগুণ বেশি প্লাস্টিক শিল্পকারখানায় সংশ্লেষণ করা হচ্ছে।
কৃত্রিম পলিমার বা প্লাস্টিক
শক্ত, হালকা, সস্তা এবং যেকোনো পছন্দসই রঙের প্লাস্টিক (plastic) পাওয়া যায়। প্লাস্টিককে গলানো যায় এবং ছাঁচে ঢেলে যেকোনো আকার দেওয়া যায়। প্লাস্টিক শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Plastikos থেকে। Plastikos অর্থ হলো গলানো সম্ভব। অনেকেই পরিত্যক্ত প্লাস্টিক অংশটি গলিয়ে নানা কিছু তৈরি করেন। এটি করা বিপজ্জনক কারণ, প্লাস্টিক দ্রব্যকে পোড়ালে বা উত্তাপে গলানো হলে অনেক রকম বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন হয়৷ খাবার রাখার পাত্র, মোড়ক, বলপেন, চেয়ার, টেবিল, গাড়ির যন্ত্রাংশ, পানির ট্যাংক, গামলা, বালতি, মগ ইত্যাদি সামগ্রী প্রস্তুত করার জন্য ব্যাপকভাবে প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়।
প্লাস্টিক ব্যবহারের সুবিধা ও অসুবিধা
বর্তমান বিশ্বে ব্যাপক হারে প্লাস্টিক জাতীয় কৃত্রিম পলিমার ব্যবহার করা হচ্ছে। এ জাতীয় পদার্থ ব্যবহারের প্রচুর সুবিধা রয়েছে। অপরদিকে, প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। বর্তমানে এ জাতীয় পদার্থ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে গেছে। তাই এগুলোকে বর্জনও করতে পারছি না। সেক্ষেত্রে এগুলোর ব্যবহার সঠিক উপায়ে করতে পারলে আমরা এ সকল অসুবিধা থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে পারি।
সুবিধা: প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ থেকে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যেমন: থালাবাসন, বিভিন্ন ধরনের পাইপ, বিভিন্ন কন্টেইনার, ব্যাগসহ আরও অনেক কিছু প্রস্তুত করা হয়। এগুলো তৈরিতে আগে সম্পূর্ণরূপে ধাতু, প্রাকৃতিক তন্তু যেমন: তুলা, পাট, রেশম, কাঠ ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। প্লাস্টিক এদের তুলনায় অনেক পাতলা। প্লাস্টিককে ইচ্ছা অনুযায়ী রূপ দিয়ে আমরা ইচ্ছামতো বিভিন্ন আকারের জিনিস তৈরি করতে পারি। তাতে বিভিন্ন ধরনের রং মিশিয়ে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারি।
অসুবিধা: প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্যের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আমরা যে সকল জিনিস মাটিতে বা পানিতে ফেলি সেগুলো ব্যাকটেরিয়া বা বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন বা মাটি বা পানিতে অন্য পদার্থের সাথে বিক্রিয়া করে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। কিন্ত প্লাস্টিক দ্রব্য যেমন ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না, তেমনই অন্যান্য পদার্থের সাথেও বিক্রিয়া করে না। তাই মাটিতে বা পানিতে ফেললে তা একই রকম থেকে যায়। ফলে মাটি ও পানির দূষণ ঘটায়। সেই সাথে পরিবেশেরও ভারসাম্য নষ্ট হয়।
আমাদের করণীয়: প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্যকে যেখানে-সেখানে ফেলে না দিয়ে তাকে সংরক্ষণ করে আবার প্রক্রিয়াজাত (recycling) করে পুনরায় ব্যবহার করা উচিত। অন্যদিকে কাঠ, ধাতু, প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের পরিমাণও আমাদের বাড়াতে হবে। বিজ্ঞানীরা পচনশীল প্লাস্টিক দ্রব্য তৈরি করার চেষ্টা করছেন এবং ইতোমধ্যে তারা অনেক ক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন। তাই আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে বাজারে বর্তমানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক দ্রব্যের পরিবর্তে পচনশীল প্লাস্টিকের তৈরি দ্রব্যসামগ্রী পাওয়া যাবে।
জৈব ও অজৈব যৌগের পার্থক্য
এ অধ্যায়ে তোমরা যে সকল যৌগ সম্পর্কে অধ্যয়ন করেছো তার সবই জৈব যৌগ। সাধারণত সমযোজী বন্ধনের মাধ্যমে জৈব যৌগসমূহ গঠিত হয় এবং আয়নিক বন্ধনের মাধ্যমে অজৈব যৌগসমূহ গঠিত হয়।
জৈব যৌগ | অজৈব যৌগ |
1. সাধারণত জৈব যৌগে কার্বন অবশ্যই থাকবে। যেমন: মিথেন (CH4) | 1. দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণত অজৈব যৌগে কার্বন থাকে না। যেমন: হাইড্রোজেন সালফাইড (H2S) |
2. জৈব যৌগের বিক্রিয়া হতে সাধারণত অনেক বেশি সময় লাগে। | 2. অজৈব যৌগের বিক্রিয়া হতে সাধারণত অনেক কম সময় লাগে। |
3. জৈব যৌগসমূহ সাধারণত সমযোজী বন্ধনের মাধ্যমে গঠিত হয়। | 3. অজৈব যৌগসমূহ সাধারণত আয়নিক বা সমযোজী বন্ধনের মাধ্যমে গঠিত হয়। |
common.read_more