পরিবর্তনশীল পরিবার বলতে মূলত ধরন পরিবর্তন হয়ে যে পরিবার সৃষ্টি হয় সে পরিবারকে বোঝায়। যেমন গ্রামীণ যৌথপরিবার ভেঙে একক পরিবারের সৃষ্টি হয়। এর মূলে বহু কারণ রয়েছে এর মধ্যে-অধিক জনসংখ্যা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, বিবাহ বিচ্ছেদ, নারীর কর্মসংস্থানসহ নানা কারণ। তাছাড়া গ্রাম ও শহরের পরিবারের সদস্যদের ভূমিকারও পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা নিজেদের পরিবারের দিকে তাকালেই বুঝতে পারব। এক সময় বাবা-মা, চাচা-চাচি, দাদা-দাদি, চাচাত ভাই বোনসহ সকলে মিলে একটি পরিবারে বসবাস করত। এখন শহরের পরিবর্তনের ছোঁয়া গ্রামেও লেগেছে। একক অর্থাৎ ছোটো পরিবার, নিজেদের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ও সুবিধা বা স্বার্থ ছাড়া অন্যদের কথা ভাবে না। যার ফলে শিশুর সামাজিকীকরণে এসব বৈশিষ্ট্যের প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।
শিশু একটি পরিবারে তথা সমাজে যেভাবে সামাজিক হয়ে গড়ে ওঠে তাকে সামাজিকীকরণ বলা হয়। শিশু পরিবারে জন্ম নেয় এবং বেড়ে ওঠে। এই বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য ও পিতামাতার নিকট থেকে যা কিছু যেভাবে শিখে এই শিখন প্রক্রিয়া হলো শিশুর সামাজিকীকরণ। এটি একটি প্রক্রিয়া যা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে। শিশুর সামাজিকীকরণে প্রথম ভূমিকা রাখে পরিবার। শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণে পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে পিতামাতার মাধ্যমেই শিশু ভাষা ও সংখ্যা শিক্ষার জগতে প্রবেশ করে। এ কারণে বলা হয়, পরিবার হলো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যৌথ পরিবারগুলোতে সন্তান-সন্ততিরা খুব অল্প বয়স থেকেই পারিবারিক পেশার সাথে সংযুক্ত হতো। সুতরাং পরিবার এক্ষেত্রে শিশুর শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে কাজ করত। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবারের এ দায়িত্ব ও ভূমিকা বর্তমানে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করেছে। শিশু শিক্ষার জন্য শিশু সদন, কিন্ডারগার্টেন, বিদ্যালয় বা মাদ্রাসা, টেকনিক্যাল বিদ্যালয়সহ বহু প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। সুতরাং পরিবারের শিক্ষা বিষয়ক ভূমিকা আগের মতো নেই। শিশু শিক্ষার মূল দায়িত্ব এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ন্যস্ত হয়েছে।
ধর্মশিক্ষার বিষয়েও পরিবারের ভূমিকা যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ শিশুর ধর্মশিক্ষা বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ। সাধারণত পরিবারের মধ্যেই শিশুর ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সম্পর্কে মা-বাবা, দাদা-দাদি বা পরিবারের অন্যান্য সদস্য বিভিন্নভাবে শিশুকে অবহিত করে। তবে সময়ের পরিবর্তনে পরিবার ছোটো হয়ে যাওয়ায় এবং বাবা-মা উভয়ের ব্যস্ততার কারণে এখন পরিবারের ধর্মবিষয়ক ভূমিকা দুর্বল হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি দেখা যায় ইউটিউবে বা ফেসবুকের অসমর্থিত সূত্র থেকে শিশুকে ধর্মশিক্ষা দিতে হচ্ছে। এতে শিশুর মধ্যে প্রকৃত ধর্মীয় মূল্যবোধ যা মানুষের জীবনে মানবিক, নৈতিক, উদারতার গুণ তৈরি করে, সেটি তৈরি বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
এতদিন পর্যন্ত শিশুর লালন পালন পরিবারেরই প্রধান দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু বাংলাদেশে এখন অনেক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হয়েছে; যারা শিশু লালন পালনের দায়িত্ব যত্নসহকারে বহন করে। তবে শহরেই এসব প্রতিষ্ঠান বেশি গড়ে উঠেছে। যেমন- চাকরিজীবী পিতামাতার সন্তানরা বেবি হোমে, ডে-কেয়ার সেন্টার কিংবা অন্যভাবে লালন পালন হচ্ছে।
যৌথ পরিবারে দাদা-দাদি, চাচা-চাচিসহ অন্য সদস্যদের সাথে পারস্পরিক আচার-আচরণের মাধ্যমে শিশুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এসব সম্পর্কের মধ্য দিয়ে শিশু সহযোগিতা, সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা, সহনশীলতা, নিরাপত্তাবোধ, সমানভাগের অংশীদার প্রবণতাসহ বিভিন্ন গুণ অর্জন করার সামাজিক শিক্ষা পায়। যা শিশুর সামাজিকীকরণে প্রভাব ফেলে। তবে যৌথপরিবার কমে যাওয়ায় এধরনের সামাজিকীকরণ প্রায় এখন দেখাই যায় না।
পরিবারের উত্তরাধিকারের মাধ্যমেই সম্পদ এবং সম্পত্তি বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা হয়ে থাকে। নারী ও পুরুষ সদস্যদের মধ্যে সম্পত্তির ন্যায্য বণ্টনের প্রশ্নটি নিষ্পত্তিতে পরিবারের ভূমিকা এখনো প্রধান মূলত প্রতিটি পরিবারের নিজস্ব ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা নির্ধারিত হয়।
পরিবারের অনেক দায়িত্ব বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পালন করেছে। শিক্ষা, বিনোদন, অর্থনৈতিক উৎপাদন ইত্যাদি অনেক কাজ এখন পরিবারের বাইরে সম্পন্ন হচ্ছে। যেমন- পার্ক, জাদুঘর ও চিড়িয়াখানার মতো বিনোদনমূলক ব্যবস্থা পরিবার করছে না। তবে জন্মদিন, বিয়ের উৎসব, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো, রেডিয়ো, টেলিভিশন ইত্যাদি পারিবারিক পরিমণ্ডলেই হয়ে আসছে।
কাজ-১: শিশুর সামাজিকীকরণের পরিবর্তনগুলো আলোচনা কর। |
common.read_more