ঘর্ষণ বল (Frictional Force)

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - পদার্থ বিজ্ঞান বল (Force) | - | NCTB BOOK
861
861

আমরা এর আগে মহাকর্ষ কিংবা মাধ্যাকর্ষণ বল এবং স্প্রিংয়ের বল নিয়ে আলোচনা করেছি, এবারে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বল নিয়ে আলোচনা করব, সেটি হলো ঘর্ষ

        

   চিত্র 3.03:একটি ভরের উপর বল প্রয়োগ করলে ঘর্ষণের জন্যে বিপরীত দিকে

                   একটি বল তৈরি হতে পারে।

ধরা যাক, একটা টেবিলে কোনো একটা কাঠের টুকরো রয়েছে এবং সেই কাঠের টুকরোর ওপর বল প্রয়োগ করে সেখানে ত্বরণ সৃষ্টি করতে চাচ্ছি। ধরা যাক,3.03 চিত্রে যেভাবে দেখানো হয়েছে সেভাবে ভরটির ওপর বাম থেকে ডানে F বল প্রয়োগ করছি, দেখা যাবে কাঠের টুকরোয় টেবিলের সাথে কাঠের টুকরোর ঘর্ষণের কারণে একটা ঘর্ষণ বল f তৈরি হয়েছে এবং সেটি ডান থেকে বাম দিকে কাজ করে প্রয়োগ করা বলটিকে কমিয়ে দিচ্ছে। 

এখন তুমি যদি মনে কর ঘর্ষণের ফলে ডান থেকে বাম দিকে একটা ঘর্ষন বল তৈরি হয় কাজেই কাঠের টুকরোর ওপরেও যদি বাম দিকে বল প্রয়োগ করি তাহলে প্রয়োগ করা বল আর ঘর্ষণ বল একই দিকে হওয়ার কারণে বাড়তি একটা বল পেয়ে যাব! কিন্তু দেখা যাবে এবারেও ঠিক বিপরীত দিকে ঘর্ষণ বল কাজ করছে। ঘর্ষণ বল সব সময়েই প্রয়োগ করা বলের বিপরীত দিকে কাজ করে৷ কাঠের টুকরোর ওপরে যদি খানিকটা ওজন বসিয়ে দিই দেখা যাবে ঘর্ষণ বল আরো বেড়ে গেছে, যদিও ওজন এবং ঘর্ষণ বল পরস্পরের ওপর লম্ব! 

ঘর্ষণ বল কীভাবে তৈরি হয় ব্যাপারটা বুঝতে পারলেই আমরা দেখব এতে অবাক হবার কিছু নেই। যদিও আপাতদৃষ্টিতে কাঠ, টেবিলকে (কিংবা যে দুটো তলদেশের মাঝে ঘর্ষণ হচ্ছে) অনেক মসৃণ মনে হয় কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখলে দেখা যাবে সব তলদেশেই এবড়োখেবড়ো এবং এই এবড়োথেবড়ো অংশগুলো একে অন্যকে স্পর্শ করে বা খাঁজগুলো একে অন্যের সাথে আটকে যায়, সেটার কারণেই গতি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং আমরা বলি বিপরীত দিক থেকে ধর্ষণ বলের জন্ম হয়েছে। যদি দুটো তলদেশকে আরো চাপ দেওয়া হয় তাহলে এবড়োখেবড়ো অংশ আরো বেশি একে অন্যকে স্পর্শ করবে, একটির খাঁজ অন্যটির আরো গভীর খাঁজে ঢুকে যাবে এবং ঘর্ষণ বল আরো বেড়ে যাবে। 

ঘর্ষণের জন্য তাপ সৃষ্টি হয়। সেটা অনেক সময়েই সমস্যা। যেমন গাড়ির সিলিন্ডারে পিস্টনকে ওঠানামা করার সময়ে সেখানে ঘর্ষণের জন্য তাপের সৃষ্টি হয় আর সেই তাপ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গাড়ির ইঞ্জিনকে শীতল রাখতে হয়। তাই সেখানে ঘর্ষণ কমানোর জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। 

common.content_added_by
common.content_updated_by

ঘর্ষণের প্রকারভেদ

239
239

ঘর্ষণকে চারভাবে ভাগ করা যায়। স্থিতি ঘর্ষণ, গতি ঘর্ষণ, আবর্ত ঘর্ষণ এবং প্রবাহী ঘর্ষণ: 

স্থিতি ঘর্ষণ (Static Friction): দুটো বস্তু একে অন্যের সাপেক্ষে স্থির থাকা অবস্থায় যে ঘর্ষণ বল থাকে সেটা হচ্ছে স্থিতি ঘর্ষণ। স্থিতি ঘর্ষণের জন্য আমরা হাঁটতে পারি, আমাদের পা কিংবা জুতোর তলা মাটিতে স্থিতি ঘর্ষণের কারণে আটকে থাকে এবং পিছলে পড়ে যাই না! 

গতি ঘর্ষণ (Sliding Friction) : একটি বস্তুর সাপেক্ষে অন্য বস্তু যখন চলমান হয় তখন যে ঘর্ষণ বল তৈরি হয় সেটি হচ্ছে গতি ঘর্ষণ। সাইকেলের ব্রেক চেপে ধরলে সেটি সাইকেলের চাকাকে চেপে ধরে এবং ঘুরন্ত চাকাকে গতি ঘর্ষণের কারণে থামিয়ে দেয়। গতি ঘর্ষণ ওজনের উপর নির্ভর করে, ওজন যত বেশি হবে গতি ঘর্ষণ তত বেশি হবে। যদি কোনো কিছুর ভর M হয় তাহলে তার ওজন একটি বল, যার পরিমাণ w = Mg। তাহলে গতি ঘর্ষণ f কে লিখতে পারি f = W এখানে গতি ঘর্ষণ সহগ।  

আবৰ্ত ঘর্ষণ (Rolling Friction) : একটি তলের উপর যখন অন্য একটি বস্তু পড়িয়ে বা ঘুরতে ঘুরতে চলে তখন সেটাকে বলে আবর্ত  ঘৰ্ষণ। সবগুলো ঘর্ষণ বলের মধ্যে এটা সবচেয়ে ছোট ।আমরা সব সময়ই সকল রকম যানবাহনের মাঝে চাকা লাগিয়ে নিই। চাকা লাগানো স্যুটকেস খুব সহজে টেনে নেওয়া যায়, যদি এর চাকা না থাকত তাহলে মেঝের উপর টেনে নিতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হতো। 

প্রবাহী ঘর্ষণ (Fluid Friction) : যখন কোনো বস্তু তরল বা বায়বীয় পদার্থ (Fluid) এর ভেতর দিয়ে যায় তখন সেটি যে ঘর্ষণ বল অনুভব করে সেটি হচ্ছে প্রবাহী ঘর্ষণ। প্যারাস্যুট নিয়ে যখন কেউ প্লেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন বাতাসের প্রবাহী ঘর্ষণের কারণে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসতে পারে  । 

common.content_added_by
common.content_updated_by

গতির উপর ঘর্ষণের প্রভাব

286
286

আমরা আগেই বলেছি ঘর্ষণ বল সব সময়ই প্রয়োগ করা বলের বিপরীত দিকে কাজ করে। সেজন্য স্বাভাবিকভাবেই ঘর্ষণ বল গতিকে কমিয়ে দেয় এবং আমাদের ধারণা হতে পারে আমরা সর্বক্ষেত্রে বুঝি ঘর্ষণ কমানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সেটি সত্যি নয়। তোমরা নিশ্চয়ই কখনো না কখনো কাদার মাঝে কোনো গাড়ি বা ট্রাককে আটতে যেতে দেখেছ। তখন গাড়ির চাকা ঘুরলেও ঘর্ষণ কম বলে কাদা থেকে গাড়ি বা ট্রাক উঠে আসতে পারে না। ঢাকা পিছলিয়ে যায়। তখন গাড়ি বা ট্রাকটিকে তুলে আনার জন্য অন্যভাবে ঢাকা এবং কাদার মধ্যে ঘর্ষণ বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। 

টায়ারের পৃষ্ঠ: গাড়ির টায়ার এবং রাস্তার মাঝে ঘর্ষণ থাকে বলে রাস্তার উপর দিয়ে পাড়ি যেতে পারে, যদি এই ঘর্ষণ না থাকত তাহলে গাড়ির চাকা পিছলে যেত এবং পাড়ি সামনে যেতে পারত না । এই ঘর্ষণ বাড়ানোর জন্য গাড়ির টায়ারে অনেক ধরনের খাঁজ কাটা হয়। যারা গাড়ি চালায় তার সব সময় লক্ষ রাখে তাদের গাড়ির চাকার খাঁজ কমে মসৃণ হয়ে যাচ্ছে কি না। যদি মসৃণ হয়ে যায় তাহলে ব্রেক করার পরও গাড়ি না থেমে পিছলে এগিয়ে যাবে! 

রাস্তার মসৃণতা: গাড়ির টায়ারের সাথে রাস্তার ধর্ষণ বাড়ানোর জন্য রাস্তাগুলো বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। রাস্তা যদি ঠিক না থাকে তাহলে সেখানে গাড়ির চাকা পিছলিয়ে (skid) যেতে পারে। শীতের দেশে তুষারপাতের পর রাস্তায় বরফ জমে গেলে রাস্তা অসম্ভব পিচ্ছিল হয়ে যেতে পারে এবং দুর্ঘটনার পরিমাণ দশ গুণ থেকে বেশি হয়ে যায়। আমাদের দেশে রাস্তায় পানি জমে কিংবা ছোট নুড়িপাথর বা কাঁকড়ের কারণে রাস্তার ঘর্ষণ কমে যেতে পারে। তোমরা সবাই পিচঢালা পথ দেখেছ, এই পিচঢালার কারণে টায়ারের সাথে রাস্তার ঘর্ষণ বেড়ে যায়। একই সাথে বৃষ্টির পানি চুইয়ে রাস্তার ভেতরে যেতে পারে না বলে রাস্তা বেশি দিন ব্যবহার করা যায়। 

গতি নিয়ন্ত্রণ এবং ব্রেকিং বল: যানবাহন চালানোর সময় প্রয়োজন অনুসারে গাড়ির গতি বাড়াতে এবং কমাতে হয়। গাড়ির গতি যখন কম থাকে তখন সেটি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়, তাই তোমরা সব সময়ই দেখে থাকবে রাস্তায় বাঁক নেওয়ার সময় বা অন্য গাড়িকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় ব্রেক করে গাড়ির গতি কমানো হয়। গাড়ির ব্রেক প্যাডেলে চাপ দিলে সেই চাপটি চাকার সাথে লাগানো “সু” বা প্যাডে স্থানান্তরিত হয় এবং সেটি গাড়ির চাকার ভেতরকার চাকভিটিতে চাপ দেয়। এই চাপের কারণে প্যাড এবং চাকতিতে ঘর্ষণ হয় এবং এই ঘর্ষণ বল পাড়ির ঢাকাকে থামিয়ে দেয়। 

common.content_added_by
common.content_updated_by

ঘর্ষণ কমানো- বাড়ানো

200
200

আমরা এর মাঝে জেনে গেছি যে আমাদের প্রয়োজনে ঘর্ষণকে কখনো বাড়াতে হয় এবং কখনো কমাতে হয়। 

ঘর্ষণ কমানোঃ 

ঘর্ষণ কমানোর জন্য আমরা যেসব কাজ করি সেগুলো হচ্ছেঃ 

1. যে পৃষ্ঠটিতে ঘর্ষণ হয় সেই পৃষ্ঠটিকে যত সম্ভব মসৃণ করা। মসৃণ পৃষ্ঠে গতি ঘর্ষণ কম। 

2. তেল মবিল বা প্লিজ জাতীয় পদার্থ হচ্ছে পিচ্ছিলকারী পদার্থ বা লুব্রিকেন্ট। দুটি তলের মাঝখানে এই লুব্রিকেন্ট থাকলে ঘর্ষণ অনেকখানি কমে যায়। 

3.চাকা ব্যবহার করে ঘর্ষণ কমানো যায়। কাচা ব্যবহার করা হলে বড় গতি ঘর্ষনের পরিবর্তে অনেক ছোট আবর্ত ঘর্ষণ দিয়ে কাজ করা যায়। ঘুরন্ত চাকাতে বল বিয়ারিং ব্যবহার করে সরাসরি ঘর্ষণের বদলে ছোট স্টিলের বলগুলোর আবর্তন বর্ষণের সাহায্যে ঘর্ষণ অনেক কমানো সম্ভব। 

4. গাড়ি, বিমান এ ধরনের দ্রুতগামী যানবাহনের ডিজাইন এমনভাবে করা হয় যেন বাতাস ঘর্ষণ তৈরি না করে স্ট্রিম লাইন করা পৃষ্ঠদেশের উপর দিয়ে যেতে পারে। 

5. যে দুটি পৃষ্ঠদেশে ঘর্ষণ হয় তারা যদি খুব অল্প জায়গায় একে অন্যকে স্পর্শ করে তাহলে ঘর্ষণ কমানো যায়। 

6. আমরা দেখেছি ঘর্ষণরত দুটো পৃষ্ঠে বল প্রয়োগ করা হলে ঘর্ষণ বেড়ে যায়, কাজেই লম্বভাবে আরোপিত বল কমানো হলে ঘর্ষণ কমানো যায়। 

ঘর্ষণ বাড়ানোঃ 

ঘর্ষণ কমানোর জন্য যে প্রক্রিয়াগুলো করা হয় সেগুলো করা না হলে কিংবা তার বিপরীত কাজগুলো করা হলেই ঘর্ষণ বেড়ে যায়। তাই ধর্ষণ বাড়ানোর জন্য আমরা যেসব কাজ করি সেগুলো হচ্ছে: 

1. যে দুটো তলে ঘর্ষণ হচ্ছে সেগুলো অমসৃপ বা খসখসে করে তোলা। 

2. যে দুটো তলে ঘর্ষণ হয় সেগুলো আরো জোরে চেপে ধরার ব্যবস্থা করা ।  

3. ঘর্ষণরত তল দুটোর মাঝে গতিকে থামিয়ে স্থির করে ফেলা, কারণ স্থির ঘর্ষণ গতি ঘর্ষণ থেকে বেশি । 

4. ঘর্ষণরত তলের মাঝে খাঁজ কাটা, বা ঢেউ খেলানো করা। তাহলে এটি তলদেশকে জোরে আঁকড়ে ধরতে পারে। পানি বা তরল থাকলে সেটি খাঁজে ঢুকে গিয়ে পৃষ্ঠদেশের ঘর্ষণ বাড়াতে পারে। 

5. বাতাস বা তরলের ঘনত্ব বাড়ানো । 

6. বাতাস বা ভরলে ঘর্ষণরত পৃষ্ঠদেশ বাড়িয়ে দেওয়া 

7. চাকা বা বল বিয়ারিং সরিয়ে দেওয়া। 

common.content_added_by
common.content_updated_by

ঘর্ষণ একটি প্রয়োজনীয় উপদ্রব

270
270

আমরা সবাই নিশ্চয়ই লক্ষ করেছি যে ঘর্ষণের কারণে তাপশক্তি তৈরি হয়। শীতের দিনে আমরা হাত খসে হাত উত্তপ্ত করি। গাড়ির ইঞ্জিন যে গরম হয়ে উঠে সেটিও ঘটে ঘর্ষণের কারণে। কাজেই ঘর্ষণের কারণে অপ্রয়োজনীয় তাপ সৃষ্টি করে শক্তির অপচয় হয়। গাড়ি, প্লেন, জাহাজ, সাবমেরিনকে ঘর্ষণ বলকে পরাস্ত করে এগিয়ে যেতে হয়, সেখানেও অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ করতে হয়। এভাবে দেখা হলে মনে হতে পারে ঘর্ষণ বুঝি আমাদের জীবনের একটি উপদ্রব ছাড়া আর কিছু নয়। 

আবার আমরা এর মাঝে দেখেছি ঘর্ষণ আছে বলেই আমরা হাঁটতে পারি, রাস্তায় গাড়ি চলতে পারে, কাগজে পেনসিল কলম দিয়ে লিখতে পারি, দালান গড়ে তুলতে পারি, প্যারাস্যুট দিয়ে নিরাপদে নিচে নামতে পারি। আমরা এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ দিতে পারি যেখানে ঘর্ষণ না থাকলে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে পারতাম না । 

কাজেই ঘর্ষণকে উপদ্রব মনে করা হলেও আমাদের মেনে নিতে হবে এটি আমাদের জীবনের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি উপদ্রব। 

common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion