একজন শাসকের কী কী গুণ থাকা প্রয়োজন-উল্লেখ করো।
বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে কয়েকজন ভিক্ষু-ভিক্ষুণী এবং মহান ব্যক্তির অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তাঁদের মধ্যে কেউ ধর্মের বিকাশে, কেউ বুদ্ধের জীবনে ও সংঘের সেবায় অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। সেসব শ্রদ্ধেয় ভিক্ষু-ভিক্ষুণী এবং মহান ব্যক্তিবর্গের জীবন ও কাজের বর্ণনাকে চরিতমালা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ চরিতমালা সম্পর্কে জানা প্রত্যেক বৌদ্ধের একান্ত প্রয়োজন।
বৌদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসারে থের-থেরীদের অবদান অনেক। ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীব্রত নিয়ে যাঁরা দশ বছর অতিক্রম করেন তাঁদের থের বা থেরী বলা হয়। থের শব্দের অর্থ স্থবির, প্রবীণ, জ্ঞানবৃদ্ধ, প্রৌঢ়, বয়োবৃদ্ধ, বয়োজ্যেষ্ঠ ইত্যাদি। থের-থেরী প্রবীণ ভিক্ষু-ভিক্ষুণীর উপাধিবিশেষ। মহৎ কর্মগুণে তাঁরা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে বিশেষ গৌরবের স্থান অধিকার করে আছেন। সুত্রপিটকের অন্তর্গত খুদ্দক নিকায়ে 'থেরগাথা' ও 'থেরীগাথা' নামে দুটি গ্রন্থ আছে, সেখানে থের ও থেরীদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাসমূহ গাথা ছন্দে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁদের এসব অভিজ্ঞতা পাঠকের চিত্তকে বিস্মিত ও অভিভূত করে তোলে। থের-থেরীদের জীবন ও গাথাগুলো আমাদের নৈতিক জীবন গঠনে উদ্বুদ্ধ করে। বৌদ্ধধর্মের বিকাশে তাঁদের অবদান অবিস্মরণীয়। জীবনকে ধর্মীয় ভাবধারায় গড়ে তোলার জন্য থের-থেরী ও বরেণ্য মনীষীদের জীবনচরিত পাঠ করা উচিত। এ পর্যায়ে আমরা আনন্দ থের ও মহাপ্রজাপতি গৌতমী থেরীর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানব।
আনন্দ ছিলেন সিদ্ধার্থ গৌতমের পিতৃতুল্য অমিতোদন শাক্যের পুত্র। সিদ্ধার্থ ও আনন্দ একইদিনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মে পরিবারে খুব আনন্দ হয়েছিল বলে তাঁর এই নাম রাখা হয়। আনন্দ অনুরুদ্ধ, ভদ্রীয়, কিম্বিল, দেবদত্ত এবং ক্ষৌরকার পুত্র উপালি একইদিনে বুদ্ধের কাছে ভিক্ষু সঙ্ঘে দীক্ষিত হন।
উপসম্পদা গ্রহণের পর তিনি পুন্ন মস্তানি পুত্রের কাছে ধর্মকথা শুনে স্রোতাপত্তি ফল লাভ করেন।
বুদ্ধের প্রিয় শিষ্য, স্মৃতিধর এবং সুদেশক হিসেবে আনন্দের সুখ্যাতি ছিল সর্বজনবিদিত। তাঁর শান্ত স্বভাব ও অমায়িক ব্যবহারের জন্য সব ভিক্ষুর কাছে তিনি খুবই প্রিয় ছিলেন; সাধারণ উপাসক-উপাসিকার কাছেও ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁকে সবাই সমানভাবে বিশ্বাস করতেন।
বুদ্ধত্ব লাভের পর বহু বছর ধরে বুদ্ধের কোনো স্থায়ী সেবক ছিলেন না। নাগসামাল, নাগিত, উপবান, সুনক্ষত্র, চুন্দ, সাগত প্রমুখ ভিক্ষুরা অস্থায়ীভাবে তাঁর সেবা করছিলেন। বুদ্ধের বয়স যখন ৫৫ বছর, তখন একবার ধর্মসভায় বুদ্ধের স্থায়ী সেবক নিযুক্ত করার প্রশ্ন ওঠে। তখন সারিপুত্র-মৌদাল্যায়ন প্রমুখ খ্যাতনামা ভিক্ষু এ পদের প্রার্থী হন। কিন্তু বুদ্ধ কারো প্রার্থনা অনুমোদন করেননি। তখন সেবক পদের জন্য আনন্দ স্থবিরের নাম প্রস্তাবিত হলে আনন্দ নিম্নোক্ত শর্ত সাপেক্ষে সেবক পদ গ্রহণে সম্মত হন। শর্তগুলো যথাক্রমে-
১. বুদ্ধের প্রাপ্ত চীবর আনন্দকে প্রদান করবেন না।
২. বুদ্ধের প্রাপ্ত পিন্ডপাত আনন্দকে দেবেন না।
৩. বুদ্ধ আনন্দকে গন্ধকুটিরে থাকতে বলবেন না।
৪. আনন্দের গৃহীত নিমন্ত্রণে বুদ্ধ গমন করবেন।
৫. আনন্দ যে-কোনো সময় আগন্তুক নিয়ে বুদ্ধের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন।
৬. ধর্ম বিষয়ে জানার জন্য আনন্দ যেকোনো সময়ে বুদ্ধের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন।
৭. আনন্দের অনুপস্থিতিতে বুদ্ধ কর্তৃক দেশিত উপদেশসমূহ আনন্দকে পুনর্ব্যক্ত করবেন।
আনন্দ বুদ্ধের সেবকপদ গ্রহণ করে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কর্তব্যগুলো পালন করতেন। তিনি প্রতিদিন দুই প্রকার জল ও তিন প্রকার দন্তকাষ্ঠ বুদ্ধকে দিতেন। তিনি বুদ্ধের শরীর পরিষ্কার করে দিতেন। এ ছাড়া গন্ধকুটির পরিচ্ছন্ন, প্রদীপ প্রজ্জ্বালন ইত্যাদি কাজও করতেন। দিনের বেলায় গন্ধকুটিরে অবস্থান করে রাতে প্রদীপ হাতে নয়বার গন্ধকুটির প্রদক্ষিণ করতেন। কারণ, বুদ্ধের প্রয়োজনে তিনি যেন উপস্থিত হতে পারেন। তিনি এভাবে বুদ্ধের পরিনির্বাণ লাভের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সেবা করেছিলেন। বুদ্ধ আনন্দ স্থবিরের ধীশক্তির প্রশংসা করে তাঁকে 'ধর্মভান্ডাগারিক' পদে অভিষিক্ত করেন। আনন্দ একাগ্রচিত্তে বুদ্ধের উপদেশ শুনতেন এবং খুব মধুরভাবে সেসব উপদেশ বুঝিয়ে দিতে পারতেন। বুদ্ধ একসময় ভিক্ষুসঙ্ঘকে আহ্বান করে বলেছিলেন, ভিক্ষুগণ! আনন্দের চারটি অদ্ভুত গুণ আছে। তা হলো: ১. আনন্দকে দর্শন করলে ভিক্ষুগণ তৃপ্তিবোধ করেন, ২. আনন্দ ধর্ম ভাষণ করলে ভিক্ষুগণ পরম তৃপ্তি লাভ করেন, ৩. আনন্দের সঙ্গে কথা বলে ভিক্ষুগণ পরিতৃপ্ত হন এবং ৪. ভিক্ষু-ভিক্ষুণী ও উপাসক-উপাসিকাগণ আনন্দকে দেখে পরম তৃপ্তি লাভ করেন।
উল্লেখ্য, বৌদ্ধ ভিক্ষুণীসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠায় আনন্দ স্থবিরের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। রাজা শুদ্ধোদনের মৃত্যুর পর শাক্য ও কোলিয়দের মধ্যে রোহিণী নদীর জল নিয়ে বিবাদ হয়েছিল। বুদ্ধ বিবাদ মীমাংসার জন্য বৈশালী থেকে কপিলাবস্তু আসেন। বিবাদ মীমাংসা করে বুদ্ধ তাদেরকে কলহবিবাদ সূত্র দেশনা করেন। দেশনা শুনে পাঁচ শ শাক্যকুমার উপসম্পদা গ্রহণ করেন। তাঁদের স্ত্রীগণ মহাপ্রজাপতি গৌতমীর নেতৃত্বে বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হয়ে ভিক্ষুণীব্রত গ্রহণ করার প্রার্থনা জানান। কিন্তু বুদ্ধ তাঁদের প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করে বৈশালীতে গমন করেন। মহাপ্রজাপতি গৌতমীসহ পাঁচশ জন সহচারিণী হতাশ না হয়ে মস্তক মুন্ডিত করে কাষায়বস্তু পরে করে খালি পায়ে বৈশালীতে উপস্থিত হন। এখানেও বুদ্ধ নারীদের ভিক্ষুণী ধর্মে দীক্ষা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আনন্দ স্থবির ভগবান বুদ্ধকে তাঁর বিমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমীর বিভিন্ন উপকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁদের দীক্ষা দেওয়ার অনুরোধ জানান। আনন্দের অনুরোধক্রমে বুদ্ধ মহাপ্রজাপতি গৌতমীসহ পাঁচশ শাক্য নারীকে উপসম্পদা করে ভিক্ষুণী সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করেন।
বুদ্ধ শেষ জীবনে বৈশালীর চাপাল চৈত্যে অবস্থান করার সময় পাপমতি মারের অনুরোধে আয়ু সংস্কার বর্জন করেন। মাত্র তিন মাস পর বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধ পরিনির্বাপিত হবেন জানতে পেরে আনন্দ অত্যন্ত শোকাভিভূত হলেন। বুদ্ধ আনন্দকে ডেকে বললেন, 'আনন্দ, তুমি শোক করবে না। আমি কি তোমাকে বলিনি যে, জগৎ অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম। সকলে প্রিয়বস্তু থেকে পৃথক হবে। সকল সংস্কার অনিত্য। তৃষ্ণা আর অবিদ্যার কারণে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। আনন্দ, তুমি মহাপুণ্যাত্মা, উদ্যম করো, মনোযোগ দিয়ে জ্ঞান সাধনায় আত্মনিয়োগ করো। তুমি অচিরে আসবক্ষয় করে অর্থলাভে সক্ষম হবে।'
বুদ্ধের পরিনির্বাণ লাভের পরে রাজগৃহে সপ্তপর্ণি গুহায় যে প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি হয়, তাতে আনন্দ স্থবিরের অসাধারণ অবদান ছিল। সপ্তপর্ণি গুহায় ৫০০ জন অর্হৎ ভিক্ষুর উপস্থিতিতে বুদ্ধবাণী সংগ্রহ করার জন্য এক মহাসম্মেলন বা সঙ্গীতি আহ্বান করা হয়। নির্বাচিত ভিক্ষুদের মধ্যে আনন্দ স্থবির ছাড়া সকলেই ছিলেন অর্হৎ। আনন্দ সঙ্গীতি অধিবেশনের আগের দিন সারা রাত ধ্যান-সমাধিতে নিমগ্ন হয়ে অর্হত্ত্বফল লাভে সক্ষম হন।
যথাসময়ে সঙ্গীতির অধিবেশন শুরু হবার আগে নির্বাচিত ভিক্ষুগণ নিজ নিজ আসনে উপবেশন করলেন। শুধু আনন্দের আসন শূন্য ছিল। অধিবেশন শুরুর পূর্বমুহূর্তে আনন্দ ঋদ্ধিশক্তির প্রভাবে তাঁর জন্য নির্ধারিত আসনে উপবেশন করলেন। এ অত্যাশ্চর্য ঘটনা দেখে সব ভিক্ষু সাধুবাদ দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানালেন। মহাকাশ্যপের সভাপতিত্বে সঙ্গীতির কার্যক্রম শুরু হয়। এই সঙ্গীতিতে উপালি স্থবির বিনয় এবং আয়ুষ্মান আনন্দ স্থবির সমগ্র সূত্র (অভিধর্মসহ) আবৃত্তি করেন। এভাবে আনন্দ স্থবির বুদ্ধবাণী সংরক্ষণে অবদান রেখেছিলেন।
common.read_more